“বলো কি গো, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?…” অনন্তহরি প্রশ্ন করিলেন। অনন্তহরিকে তাঁহার দক্ষতার গর্ব এখনও অনেকটা স্ফীত করিয়া রাখিয়াছে। এ জয়ের নিকটে যে কোন মনোভাব তুচ্ছ, দুৰ্বল।
লক্ষ্মীনারায়ণ এমত মনে হয় বৃক্ষরোপণ দেখেন নাই, হরিৎক্ষেত্র বলিতে কোন পাখী অথবা নদীর নাম বুঝায় তাহা যেন তাঁহার জানা নাই, মেলা খেলায় বাজিকরকে ডম্বরু বাজাইতে দেখিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। তিনি জড়বৎ সম্বিৎহীন, কোনক্রমে মাথা দুলাইয়া, যেহেতু অনন্তহরির গৰ্ব্ব তাঁহাকে আহত করিয়াছিল, উত্তর করিলেন, “বোধ হয়…
কিন্তু আমার কি হবে?” তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইল, এ কথায় দীক্ষালোভীর তীব্র ব্যাকুলতা ছিল, এবং তাঁহার দেহ দিয়া আশ্বিনের প্রমত্ত ঝড়ের ক্রমাগতই শব্দ নির্গত হয়; পূৰ্ব্বে ঐ নির্বাক জবুস্থবু অবস্থার মধ্যেও হয়ত বা লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার নাম মনে করিতে পটু ছিলেন, ফলে সহজেই এ প্রশ্নও তাঁহার মনে আসিয়াছিল, ইহা কি সত্য! এবং এখন বেলাতটের আবছায়া ইয়েরোগ্লিফিক বিশ্লেষণের প্রতি ক্ষণেক দৃষ্টিপাত অন্তে জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসাও করিয়াছিলেন, “সত্যি অনন্ত.দোসর…” বলিবার কালে তাঁহার অঙ্কুরিত কাঁচাপাকা দাড়িসমেত মুখোনি অত্যন্ত কিস্তৃত হইয়াছিল। যদিচ তাঁহার বদনমণ্ডল আৰ্য্যশোভা বিমণ্ডিত।
এ প্রশ্ন একাধারে তাঁহাকে কোথায় যেমন বা তলাইয়া দিয়াছিল; আপনার দৃষ্টি দিয়া গুরুভারসম্পন্ন দেহকে রক্ষা নিমিত্ত চেষ্টা করিবার সুযোগ পৰ্য্যন্ত পান নাই, তেমনি অন্যত্রে হাজার কণ্ঠে জয়ধ্বনি তাঁহাকে নির্ভীক করিয়া তুলিয়াছিল।
জ্যোতিষী অনন্তহরি তাঁহার এ প্রশ্ন শুনিবামাত্র বিশাল হইয়া উঠিয়া সদম্ভে উত্তর করিলেন, “আরে বাবা এ কি চন্দ্র সূর্যের বিচার! তাদের বাপের ইচ্ছে; ভুল যদি হয়…আমার মাথায় ঘোল ঢেলে দিও। কার কলম তা জান?”
লক্ষ্মীনারায়ণ, বালিকাবধূ যেমত বা, জন্মগত সংস্কারবশে শিহরিয়া উঠিলেন; তাঁহার শত সহস্র রোমকূপে স্বেদবিন্দু সকল আসিয়া থমকাইল, যেহেতু তিনি অনুধাবন করিতে পারিয়াছিলেন ইহাই সত্য, ইহাই পথ। কেননা তাঁহার সমক্ষে অক্ষয় পরিক্রমণ সশরীরে আবির্ভূত, যেখানে সূৰ্য্যচন্দ্রগ্রহনক্ষত্ররাজি স্তন্যপায়ী উলঙ্গ শিশুমাত্র! তদনন্তর হাতে হাত ঘর্ষণে আপনাকে অনুভব করিয়া সাহসে সহজ হইয়া দেখিলেন অশীতিপর কালাহত সীতারামের গলে দিব্য বনমালা দুলিতেছে, আর যে বৃদ্ধ সীতারাম কোন এক ঐশ্বৰ্য্যভাবে বাঁকা–সৰ্ব্বলোক আরাধ্যা প্রাণাধিকা রাসেশ্বরীর ভাবে যেমন কৃষ্ণচন্দ্র বঙ্কিম–তেমনি; তিনি, স্থিতপ্রজ্ঞ সীতারাম অনাগত কাহার মধুরভাবে বঙ্কিম হইয়া আছেন। লক্ষ্মীনারায়ণের ঘুণাক্ষরেও মনে হয় নাই জ্যোতিষীর দম্ভ সর্বৈব মিথ্যা হইতে পারে, মনে করিবার আর কোন তর্কও উপস্থিত নাই, কারণ তাহা সত্য, অবশ্যম্ভাবী, কেননা অশরীরী কাহারা ঊর্ধলোক হইতে তিন সত্য করিয়াছিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার আবেগ রোধ করিতে অপারগ, এবং তদ্দণ্ডেই উঠিয়া দৌড়াইয়া গিয়া জ্যোতিষী অনন্তহরির হস্তধারণপূৰ্ব্বক রোরুদ্যমান কণ্ঠে ক্রমে ক্রমে কহিলেন, “ভাই অনন্ত, মান বাঁচাও, মান বাঁচাও আমার। ব্রাহ্মণের ইহকাল পরকাল রক্ষা কর…কোন উপায়ে ওদের রাজী করাও…যদি না হয় আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দেবো তুমি তুমি…”
লক্ষ্মীনারায়ণের কম্পমান হস্তের মধ্যে, মনুষ্যোচিত ব্যাকুলতার মধ্যে যেখানে ত্রিসন্ধ্যা এক হইয়া শান্তি লাভ করে, যাহার দ্বারা সমগ্র পরিদৃশ্যমান বিশ্বকে আপনার বাতায়নে দাঁড়াইয়া অক্লেশে আপনার মত দেখিতে গিয়া মানুষ আপনাকেই প্রমাণরূপে জানিয়াছে, এবং সর্বপ্রথম সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়াছে, তখনও রাত ছিল, আকাশে তারা ছিল–এবম্প্রকার হস্তের মধ্যে অনন্তহরির হাতও কাঁপিতেছিল, ফলে আপন হস্তধৃত কাঠির কলম, যাহাতে অনন্ত জ্যোতির্মণ্ডলের ধূলিকণা লাগিয়াছিল–তাহা যেন বা শীতকাতর।
অনন্তহরি লক্ষ্মীনারায়ণের এহেন ব্যবহার দর্শনে, যাহার মধ্যে বজ্র ছিল, রমণীর ন্যায় তিনি ঈষৎ লজ্জাশীল বটে এবং কথঞ্চিৎ নড়বড়েও হইয়াছিলেন। পরক্ষণেই আশপাশ দেখিয়া দ্রুত বলিলেন, “আঃ খুড়ো ছাড় দিকি” বলিবার কালেই অতর্কিতে চিতাধূম আসে, আর যে তিনি নিজের মুখোনি আড়াল করিতে ব্যস্ত হন, তাই “লোকে কি বলিবে” একথা তাঁহার অব্যক্ত রহিল, অথবা চিরআয়ুষ্মন ধূম্ররাজি তাঁহাকে সচেতন করিল।
লক্ষ্মীনারায়ণের এইরূপ বন্ধনে পুরাতন সনাতন প্রকাশের মধ্যে নিটোল সম্পূর্ণ মুক্তি ছিল, জ্যোতিষীর অনুরোধ সত্ত্বেও হাত দুইখানি ছাড়িয়া দিবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না, কেননা আপনার বিশ্বাস, আপনার ধর্মের নয়নাভিরাম রূপ এখানে দেখা দিয়াছিল; আরও দেখিয়াছিলেন, তাঁহার কৰ্ম্ম, বায়ুচালিত চৈত্রের বিশুদ্ধ পাতার মত উধাও হইবার পূর্ধ্বমুহূর্তে কামজ্বর পীড়িত জীবের মত চঞ্চল!
এই শ্মশানের ভয়ঙ্কর ধূমরাশি, ইদানীং যাহা কিয়দংশে সবুজ, তাঁহাকে মোহগ্রস্ত করিতে সক্ষম হয় নাই, চক্ষুকে রক্তিম করিয়াছিল সত্য, কিন্তু তাঁহার অন্তস্থ সঙ্কল্প হইতে তাঁহাকে মনে বিচলিত করিতে পারে নাই! লক্ষ্মীনারায়ণ সংস্কারহীন নির্লিপ্ত বাস্তব জগতকে পর্য্যবেক্ষণ করিলেন, একটি দুর্ধর্ষ দেহ তথা বৈজুনাথ ধীর পদবিক্ষেপে ঘোরা ফেরা করে, নিকটে প্রজ্জ্বলিত চিতা যাহার মধ্যে অস্থিমেদ মাংস কৃষ্ণবর্ণ, ক্রমে পৃথিবীর আয়তনকে নিশ্চয়ই স্ফীত করিতেছে–এপাশে জলধারা অন্যদিকে পত্ৰবাহার। ইহারা কেহই সত্য নহে; কিছুই, না শ্মশান না জলধারা কিছুই তাঁহাকে নিৰ্ব্বোধ করিবার মত পূর্ণতা লাভ করে নাই। এই সসাগরা বসুন্ধরা তাঁহার জন্য বাঁচিয়া থাকুক, ইহাদের দিয়া তাঁহার ব্যক্তিগত কাজ আছে–কেননা তিনি সংস্কার আচ্ছন্ন–এমত মনে হয় নাই। ঈষৎ পূর্বের অবসাদগ্রস্ত মনোভাব এখন অপাংক্তেয়, বুদ্বুদধৰ্ম্মী। লক্ষ্মীনারায়ণের লক্ষ মনোবাসনা আর এক, তাহা এই হয় যে, কাল ক্রন্দনের অন্তর্গত, কিন্তু স্পন্দন নিশ্চিন্ত সত্য, কেননা উহা বিনিষ্কম্প স্তব্ধতায় ফুটে-উঠার একমাত্র দুর্ধর্ষ যুক্তি। পুনরায় তিনি, অল্প সুস্থতা পাইয়া জ্যোতিষীর হাত ঝাঁকানি দিয়া কহিয়াছিলেন, “তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। অনন্ত আমাকে বাঁচাও-”তুমি যদি বলে দাও–তাহলেই হবে…এখনো ত আয়ু আছে…”।