“ফের বেটা হারামজাদা চাঁড়াল! বড় বাড় বেড়েছে তোর…খড়ম পেটা করে আমি তোর নাম ভুলিয়ে দেবো…ছোট জাত।”–জ্যোতিষী তাহার উল্লাস দর্শনে রাগতভাবে এবম্বিধ কহিয়াছিলেন; ইহা অকৃত্রিম কিম্বা ইহার মধ্যে ইতস্তততা ছিল তাহা সঠিক বলিবার উপায় নাই; অন্যপক্ষে স্মৃতি-উদ্ভূত সম্ভবতার সম্মুখে যে অস্পষ্টতা, তাহা তাঁহাকে এক অলিখিত স্বরভঙ্গতার মধ্যে আনে; পুনৰ্ব্বার, হয়ত এই সত্য যে, সম্ভবতা যাহা বৰ্ত্তমানবৎ তাহা যে ভোজবিদ্যা দেখাইয়াছে, উহা যদিচ ভয়ঙ্কর তবু নির্ঘাত নিশ্চিত অব্যর্থ, সে কারণে মনুষ্যপদবাচ্য যে কোন জীব–এখন চাঁড়াল বৈজুনাথ, যে তাহার বিরোধিতা করিবে, উহাকে উপহাস করিবে–তাহা অপ্রমত্ত অনাৰ্য্য বালখিল্যতা এবং ইহা বাঞ্ছনীয় নহে। কারণ কোথাও না কোথাও উহা শ্ৰীসম্পন্ন, সুন্দর, স্বাভাবিক!
নিরভিমান বৈজুনাথ দমিল না, প্রসন্ন মনে তাঁহার কথার উত্তর দিল, “আর কোত্থাকে দোসর পাবে গো…তাই না বুলোম বটে, আমায় লিবে” বলিয়া এই দুইজন ব্রাহ্মণ ছাড়া তাহার আপনার কথার সায়-সাক্ষী লাভ করিবার আশায় অন্যান্য দিকে পর্য্যবেক্ষণ করিল।
জ্যোতিষী তৎক্ষণাৎ মুখভঙ্গী সহকারে কহিলেন, “হেঃ হেঃ আমায় লিবে”–ইহার পর আপনার কণ্ঠস্বরে সাবধানতার ছল আনিয়া বলিলেন, “হারামজাদ, তোর সাহস ত বড় কম নয়। সাধে কি চাঁড়াল জন্ম হয় তোর, কুট হবে, বেটা কুট হবে, বেটা বামুনের দোসর!” এইখানেই থামিতে হইল, এই জন্য যে সহসা এক ঝলক উগ্রতীব্র নরবসার গন্ধসহ ধূম ব্রাহ্মণের মুখোনিকে বিকৃত করে, তাঁহাদের দুইজনের অবয়বকে ধূসরে সমাচ্ছন্ন করিয়াছে; এবং জ্যোতিষীর শোযোক্ত কথা এ ধূমরাশি বহুদূরে লইয়া গিয়াছিল, এবম্প্রকার বাক্যে বৃক্ষের পত্রনিচয় চুপ, পক্ষিসকল উধাও। এখন আর পাণ্ডুর অস্পষ্টতা নাই। জ্যোতিষী চিক্ করিয়া থুতু ফেলিয়া কহিলেন, “পাষণ্ড, বেটা তুই কুকুর হয়ে জন্মাবি।”
ব্রাহ্মণের বাক্যে মুহূর্তের জন্য সকল কিছুই যেমত বা বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে; বৈজুনাথ, আশ্চৰ্য্য যে, কোন দৈববশে সহসা যেন ক্ষুদ্রকায়া হইয়াছিল, তাহাকে দেখিলে মনে হয়, পৃথিবী নহে–আপনার আকাশ লইয়াই বহু দেশে দেশে সে ভ্রমণ করিয়াছে, এখন বেচারী ক্লান্ত; এখন সে আপনকার নাসাপুট কম্পিত করত নিঃশ্বাস লয় এবং কহিল, “সে বড় ভাল হবে গো ঠাকুরকুকুর হওয়া ঢের ভাল”– বলিয়া অসহায়ভাবে হাসিল। ইহার অর্থ, হয়ত এই হয়, আহার-নিদ্রা-মৈথুন-ভয়ই আমার ভাল। এখানে প্রকাশ থাকে, কিছুদিন পূর্বে এক সাধকের নিকট ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’ গীতটি শুনিয়া সে ভাবিয়াছিল শিখিবে; বিশেষত, কল্পতরুমূলে চারি ফল কুড়ায়ে পাবি’ পদটি ভাবিয়াছিল গঙ্গায় পা ডুবাইয়া অন্ধকার রজনীতে প্রাণ-ভরিয়া গাহিবে। সে আশা নিশ্চয়ই আর নাই। অনন্তর কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “তবে, তবে কাকে লিবে গো ঠাকুর?”
এ হেন সরল প্রশ্নের বাক্যনিচয়ে সকালের আলোক পরিচ্ছন্নরূপে দেখা গেল।
“ফের হারামজাদা! যা বলছি এখান থেকে” বলিয়া জ্যোতিষী আর আয়ুক্ষয় না করিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ ভূমিতে বসিয়া পড়িয়াছেন, আপনার জানুর উপর হস্ত স্থাপন করিয়া অধুনা বিনিদ্রা-জনিত ভারে অবসাদতিক্ত মস্তক রাখিয়া চক্ষু বুজাইয়াছিলেন। তাঁহার শরীর এই গণনার ফল ঘোষণায় অধিকন্তু নির্জীব, শীত-উষ্ণ বোধের সাধারণত্বের বাহিরে তিনি আপনা হইতেই সরিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন; আবার মনে হয়, তিনি নিশ্চিতভাবেই স্থির। যতক্ষণ গণনা চলিতেছিল, মন্ত্ৰপড়ার মত ভৌতিক শব্দ হইতেছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম জ্ঞান তাঁহাকে স্বাভাবিক বৈষয়িক রাখিয়াছিল; এখন নিছক বিকারগ্রস্ত, স্নায়ুসকল পিঙ্গলকৃষ্ণ-বৃক্ষে পত্রাদি তিরোহিত কখনই হয় নাই, ভেককুলকে হরষিত করিবার নিমিত্তই প্রাবৃট পটলে মেঘমালা দেখা দেয়–লক্ষ্মীনারায়ণ, এরূপ প্রত্যয় হয় যে অঘঘারে ঘুমাইতেছেন।
“আই লক্ষ্মীনারায়ণ খুড়ো” জ্যোতিষী ডাকিলেন। কোন সম্পর্কে লক্ষ্মীনারায়ণ অনন্তহরির খুল্লতাত হইতেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ এই ডাকে জাগিলেন সত্য, কিন্তু মাথা তুলিতে সমর্থ হইলেন না। কে যেমন বা জোর । করিয়া তাঁহার চক্ষু দুইটি মেলাইয়া ধরিয়াছে, যাহার একটি উস্কো চুলের তলে বিশ্রীভাবে চাহিয়া আছে। নিকটস্থ শব সৎকারের ধূমে তাহা যারপরনাই লাল, তৎসহ নরবসার গন্ধে দেহ ইন্দ্রিয়হীন অশরীরী বিকল, স্মৃতি তাঁহার এমন কি ধমনীর আশ্রয় ত্যাগ করত বহুদূরে কোন গ্রামে বিশৃঙ্খল আলুথালু প্রতীক্ষারত, এবং কৃতসঙ্কল্প বিমূঢ় তাঁহার চেতনা। বস্তুত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্রণবিরহিত সৌন্দর্য্যে রাত্র কিম্বা। দিনের কোন প্রভাব নাই, আশ্চর্য্য অথচ ভ্রমরের বিচিত্র ভাব সিদ্ধির অন্যতম কল্পনা বিদ্যমান; উহা । অজর–শুভ্রতায় যাহার জন্ম, পদ্মে যাহার জৈব ধৰ্ম্মের সৰ্বার্থসাধক বিহারভূমি, মৃত্যু যাহার নাই, সমাধিতে যাহার অস্তিত্ব। শ্মশান উহার ইহজনমের উপলব্ধি নহে, জীবনকে ভালবাসার সম্যক কারণও নহে। ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম এক এবং ব্রাহ্মণ আর এক, ইহা ভাবিবার মত ধৃষ্টতা আমাদের নাই। তথাপি কেন যে অতর্কিতে এ হেন শূন্যতা,–মীন হইতে মানুষ যাহার আধার মাত্র–সেই শূন্যতা বাক্য-দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করিয়া উপছাইয়া পড়িয়াছিল; তাহা আংশিকভাবে কল্পনা করিতে পারিলেও লক্ষ্মীনারায়ণ স্বীয় জিহ্বায় অন্য এক স্বাদ পাইবার চেষ্টা করিলেন; এবং অপ্রয়োজনে এদিক-সেদিক চাহিয়া মনে হইল, কোথাও কেহ নাই, ভয়াবহ নির্জনতায় এ স্থান পূর্ণ আর এ শ্মশানভূমি আপনার শায়িত ভৈরব রূপ, শবাসন পরিত্যাগ করিয়া দৃষ্টির সমক্ষে অতিকায় প্রাচীরবৎ দণ্ডায়মান। কারণ বারম্বারই একটি বালিকার, যে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা সর্বাংশে লক্ষ্মীপ্রতিমার ন্যায়, তাহার সরল নিৰ্ম্মল মুখমণ্ডল তাঁহার মানসপটে ভাসিয়া উঠিয়া তাঁহাকে সৰ্বরূপে বিমূঢ় করিয়াছে এতদৃষ্টে লক্ষ্মীনারায়ণ ঈষৎ শঙ্কিত হইয়া অপ্রস্তুত হইয়া জ্যোতিষীকে ঝটিতি বলিলেন, “বলো।”