বৈজুনাথের আয়ত চক্ষুদ্বয় কোথায় যে স্থায়ী হইবে, তাহা ঠিক পায় নাই। এমত সময় শুনিল, জ্যোতিষী আস্ফালন করিতেছেন, “শালা যাবে কোথায়”, এ কথা শুনা মাত্রই সে যেমন নির্বোধ, তাঁহার দিকে তাকাইল। জ্যোতিষী তখনই’জিহ্বার দ্বারা আপনকার ওষ্ঠ তৃপ্তির সহিত লেহন করত করিলেন, “শ্যালা! ভৃগু যাবে কোথায়…।” এক হস্ত হইতে অন্য হস্তে হুঁকা লইয়া মহা দম্ভে টানিতে লাগিলেন। এইবার হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া কিঞ্চিৎ ধোঁয়া ছাড়িয়া সদর্পে হাসিয়া উঠিলেন। সৌরজগৎ তিন সত্য করিল।
“অনন্ত…” কম্পিতকণ্ঠে লক্ষ্মীনারায়ণ অনন্তহরির উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ার বেগ সামলাইতে না পারিয়া ডাকিয়া ছিলেন। তাঁহার স্বরে যাত্রার শেষ দৃশ্যের শেষ রাত্রের অসংযম ফুটিয়া উঠিল।
“সাত তাড়াতাড়ি ঘর থে কেন বার করলে বুড়োকে হে? বড় কঠিন জান!” বলিয়া মাথা দুলাইয়া “হ্যাঁ হ্যাঁ” বলিয়া আপনার বিশ্বাসকে দৃঢ় করিয়া পুনরায় কহিলেন, “বড় কঠিন জান গো৷” বলিয়া, হুঁকা নিকটের মালসার কাছে রাখিলেন।
বৈজুনাথ জ্যোতিষীর অসংলগ্ন বাক্যে বড়ই ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিল, সে একদা অনন্তহরির মুখপানে অন্যবার মানসিক যন্ত্রণা পীড়িত লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করত আপনার পরনের ঠেটিতে ক্রমাগতই হাতের তালু ঘষিতে ঘষিতে কহিল, “সে কি?” এ সময় তাহার কথায় এলোমলো অবিশ্বাসের ব্যঞ্জনা ছিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ প্রায় বৈজুনাথের সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া বলিয়াছিলেন, “বল কি?”
জ্যোতিষী কিঞ্চিৎ সমতা লাভ করিয়াছিলেন, কেননা গ্রহ সকল তিন সত্য করিয়াছে, তাহা স্বকর্ণে তিনি শুনিয়াছেন, ফলে আর চাপল্য নাই। তাঁহার দৃষ্টি এখান হইতে সোজা গিয়া পড়িল অদূরবর্ত্তী কীৰ্ত্তনদল বেষ্টিত স্থানে, যেখানে একটি স্থলিত পদবিক্ষেপে ভ্রমণরত বৃত্তের মধ্যে সীতারাম শায়িত। এই দৃশ্য দেখিতে দেখিতে তিনি যেন নিজেকে হারাইয়া ফেলিলেন! একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করত কহিলেন, “সীতারাম! ভাগ্য! পূর্ণিমায় যাবে” বলিতে বলিতে তিনি অতি ধীরে আপনার মুখমণ্ডল ঘুরাইতে লাগিলেন।
“পূর্ণিমা? বল কি ঠাকুর!” বৈজুনাথ ভীত হইল।
“পূর্ণিমা! পূর্ণিমা! চাঁদ যখন লাল হবে” বলিয়া উঠিতেই তাঁহার সর্ব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমত বা একটি বিন্দুতে পরিণত, রক্তিম চন্দ্রিমা আখ্যাটিতে তাঁহার অন্তরীক্ষ রহস্যময় দিব্য বিদ্যুতের আলোয় সমাকীর্ণ; এমন একদা চন্দ্র লাল হয়, যোদ্ধৃ সকল সমবেত হন, পাঞ্চজন্য বাজিয়া উঠে, ঘোর যুদ্ধের রক্তে ধরণী প্লাবিত হইয়াছিল–আকাশে পক্ষী ছিল না। এই ক্ষণ-চিত্র দেখিয়া তিনি, অনন্তহরি, নিষ্ঠার সহিত নমস্কার করিয়া কহিলেন, “চাঁদ যখন লাল তখন তার প্রাণ যাবে…যাবে কিন্তু একা যাবে না হে। দোসর নেবে…” একথা তিনি সকালের উদ্বেলিত গঙ্গার দিকে চাহিয়া বলিয়াছিলেন। হয়ত একথা বলিতে তাঁহার ইতস্তততা ছিল।
এই ভয়ঙ্কর আজ্ঞা, লক্ষ্মীনারায়ণ ও বৈজুনাথ দুইজনেই শুনিয়াছিল, দুইজনেই বিশেষ বিভ্রান্ত, দেহের নিকটে ভীমরুল আসিলে মানুষ যেমত ব্যতিব্যস্ত হইয়া কাঁপিয়া উঠে, তেমনি বৈজুনাথ কম্পমান, রোমাঞ্চিত। সে খানিক অস্ফুট শব্দ করত কহিল, “বল কি দোসর!”
জ্যোতিষীর এখনও ধ্যানস্থ অবস্থা, দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর করিলেন, “দোসর!”
“দোসর!” বলিয়া বৈজুনাথ এক-পা পিছু হাটিয়া গিয়া মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটাইয়া, একদা গঙ্গার দিকে পরক্ষণেই শ্মশানের চারিদিকে চাহিয়া, কুকুরের মত ঘ্রাণ লইবার চেষ্টা করত ভৌতিক প্রমাদ গণনার মধ্যে দণ্ডায়মান থাকিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। ইহার পর যখন প্রশ্ন করিল, “সে কি ঠাকুর, দোসর পাবে কোথা থেকে?” তখন তাহার কণ্ঠস্বরে জীরেন রসের হিম ছিল। কৌতুক ছিল না। এ প্রশ্নে, নিমেষেই সে যেন উৰ্দ্ধ জ্যোতির্মণ্ডল হইতে ছুটিয়া আসিয়াছে এমত মনে হইল; যে বিরাট সৃষ্টির আর এক অঙ্গের তথ্য সম্যকরূপে জানে, পৃথিবীর স্বভাবময়ী প্রকৃতি যাহার আদিঘর, বন্ধন যাহার বীজমন্ত্র। যদিও ‘দোসর’ বাক্যের আপনকার সৌন্দৰ্য্য বিদ্যমান, যদিও হাটে মাঠে সে বাক্যের নিয়ত প্রতিধ্বনি শ্রুত, যদিও সে বাক্য অনন্ত জ্যোতির্মণ্ডলের এক নির্ঞ্ঝাট ত্রিগুণামিতিক বিচিত্র আকর্ষণ; কিন্তু সে বাক্য দেহ ধারণ করিয়াছে। ব্রাহ্মণ দুইজন আর এক ভাবের মানুষ, আপনকার গাত্র লেহন করিয়া পশুসকল যেমত আরাম পায়, তেমনি হঁহারা আপন আপন চক্ষুদ্বয়কে, মনকে, শ্বেতপদ্মকুসুমাদপি বিবেককে জিহ্বা দ্বারা লেহন করিতেছিলেন।
প্রথম অধীর বৈজুনাথ, আপনার পতিত জমির ন্যায় অনাদৃত বক্ষে হস্ত বুলাইয়া উর্বরতা, আদিম উৰ্ব্বরতাকে উত্থিত করত বেলাতটের ধূসর তান্ত্রিক যন্ত্রসমূহের মত অসংখ্যের হেতু, প্রক্ষিপ্ত অঙ্কের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল। যাহা কালকে ইদানীং আপনার বাস্তবতাবলে এ হেন রূপ দিয়াছে যাহাতে তাহার ছায়া পর্যন্ত দৃশ্যমান। দুঃসাহসী বৈজুনাথ অধিকন্তু অনুধাবন করে যে রৌদ্রকর্মা অমোঘ বীভৎসতা এ সকল প্রতাঁকের পশ্চাতে ঘূর্ণায়মান, এবং ক্রমান্বয়ে আঘাত হানিতেছে। ইহাকে পরাস্ত করিবার মানসে অনন্তর এমন এক অঙ্গভঙ্গী করে যাহার অর্থ এই যে, এ বিশ্ব সংসারের ঊর্ধ্বে, নভে, জ্যোতির্মণ্ডলে কোথাও যদি সে পাঁচন হস্তে স্থিতবান হইতে পারিত, তবে ভালবাসার এই পৃথিবীকে অন্যত্র, আর এক ঘরে, লইয়া যাইত; ইহাতে তাহার ঔদ্ধত্য প্রকাশ হইত না এবং নিঃসন্দেহে দেবতাগণ। পুষ্পবৃষ্টি করিতেন। সেই অঙ্গভঙ্গীর কারণ এই যে, সে নিজস্ব প্রশ্নের গুরুভারে অত্যধিক হতবুদ্ধি হইয়া বিশেষরূপে নিষ্পেষিত হইতেছিল, কেননা সে ক্ষণিকের জন্য অনুভব করিল, স্বকর্ণে শুনিল, আধো স্বরে সমগ্র বসুন্ধরা–যাহা অন্তরে অনির্বাণ, মধ্যে সুপ্তি আচ্ছন্ন, এখানে শ্লেষাত্মক ভাষার উদর বিশিষ্ট–সেই বসুন্ধরা তাহাকে পিতারূপে সম্বোধন করিতেছে। ইহা শ্রবণে এই প্রথম সে, বৈজুনাথ, আপনার নিঃশ্বাস বায়ুকে আপনার সহজ চোখে দেখিয়াছিল। সে বুঝিল যে তাহার শ্বাসকষ্ট হইতেছে, রোমসকল হরষিত, গাত্র রিমরিম; কেননা আমরা জানি স্তনহীন মৎস্যসংসার যেমত স্বীয় দৃষ্টি দ্বারাই আপন আত্মজগণকে লালন পালন করে, তেমনি সে, বৈজুনাথ, পদতলে যাহার মৃত্তিকা বিস্তার, আর এক হতভাগ্য! তাহার উপায় অন্তর নাই, তবু সে আপন বক্ষ হইতে আদিমতা উজ্জীবিত হস্তখানি উঠাইয়া প্রকাশ্যে সমর-আহ্বান ভঙ্গীতে, আপনার তন্ময়তার মধ্যেই, আন্দোলিত করিয়া পরক্ষণেই মহা কৌতুকে কহিল, “দোসর! দোসর বলতে তবে বুঝি আমি! বুড়া বুঝি আমায় লিবে গো” তাহার শেষ পদটিতে ঝুমুরের ছন্দ ছিল এবং বলিতে বলিতে সে মহা উৎসাহে লাফাইয়া উঠিয়াছিল। এখন সে আপনার ঊরুদেশে অতীব আহ্লাদে চাপড় দেয়।