অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদারের লেখা একটি সমকালীন উপন্যাস। অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্প্ররকে অনেকে জানতে চেয়েছে। আমি বলব আপনে মনোযোগ সহকারে উপন্যাসটি পড়ুন তাহলেই আপনার সকল প্রশ্ন উন্মোচিত হয়ে যাবে। অন্তর্জালী যাত্রা কমলকুমার মজুমদারের প্রথম এবং একমাত্র উপন্যাস যাহা ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়।
অন্তর্জলী যাত্রা বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ অন্তর্জলী যাত্রা
- লেখকের নামঃ কমলকুমার মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
- প্রকাশিতঃ ১৯৫৯
অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস
উপন্যাস ভূমিকা – কমলকুমার মজুমদার
ভূমিকা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
জীবনানন্দ দাশের অন্তত বারো কিংবা চোদ্দোটি উপন্যাসের (দু’টিকে বড়গল্প বলা যায়) সন্ধান পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত এবং সম্ভবত আরও চারখানি উপন্যাস লুক্কায়িত আছে তাঁর পাণ্ডুলিপির জীর্ণ ভূপে। সেগুলি পুনরুদ্ধার কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন ভূমেন্দ্র গুহ। এবং ছোটগল্প লিখেছেন প্রায় একশো কুড়িটি। তাঁর জীবদ্দশায় এগুলির একটিও প্রকাশিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথেরও উপন্যাসের সংখ্যা বারোটি এবং ছোটগল্পও একশো’র কমই হবে। সবই তিনি দেখে গেছেন মুদ্রিত অবস্থায়। রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে কবি ও কথাসাহিত্যিক। কিন্তু জীবনানন্দের এই দ্বিতীয় পরিচয়টি গুপ্ত ছিল বহুদিন। কেউ শখ করে একটি-দুটি উপন্যাস রচনা করতে পারেন, মুদ্রণের সম্ভাবনা থাক বা না থাক। কিন্তু এতগুলি উপন্যাস ও গল্প রচনা, যা বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজও বটে, কোনো রকম পাঠক-প্রত্যাশা না করেও একজন মানুষ, বিশেষত। একজন কবি, কেন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
কমলকুমার মজুমদার উপন্যাস লিখেছেন আটটি এবং কিছু গল্প। উপন্যাসগুলি এবং প্রায় সব গল্পই প্রকাশিত হয়েছে এক্ষণ, কৃত্তিবাসের মতন পত্রিকায়, কোনো বহুল প্রচারিত, অভিজাত বা সওদাগরি পত্রিকায় সে সব রচনার স্থান হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু দুটি ছোট গল্প, ‘মতিলাল পাদরি’ ও ‘তাহাদের কথা’ মুদ্রিত হয়েছিল সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। কমলকুমার জীবনানন্দের মতন নিঃসঙ্গতা বিলাসী ছিলেন না। জীবনানন্দ যেন ইচ্ছে করেই তাঁর উপন্যাস-গল্পগুলি রেখেছিলেন পাঠকদের চোখের আড়ালে, কেন না, যে-সব পত্র-পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন, তার কোনোটিতে একটু চেষ্টা করলে তাঁর উপন্যাস-গল্প ছাপা হতো না, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বাংলার অনেক কবিই কিছু কিছু গদ্যকাহিনী লিখেছেন, যেমন মাইকেল মধুসূদন, নজরুল ইসলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী প্রমুখ, সবই মুদ্রিত, শুধু জীবনানন্দ তাঁর একটিও গদ্য কাহিনী কেন প্রকাশ করতে চাননি, সে রহস্য আর বোধহয় উদঘাটিত হবার সম্ভাবনা নেই।
কমলকুমার অল্প সংখ্যক পাঠক পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, সেই জন্যই তিনি একটার পর একটা উপন্যাস লিখে গেছেন ছোট পত্রিকায়। হয়তো তিনি সচেতন ছিলেন, তাঁর রচনারীতি বৃহত্তর পাঠক সমাজের জন্য নয়। রচনাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না, যতদূর জানি, তাঁর একটি মাত্র উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এবং একটি গল্প সংকলন ‘নিম অন্নপূর্ণা’ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবিতৎকালে। আর একটি উপন্যাস ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল, মুদ্রণ সম্পূর্ণ হবার আগেই তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে।
এর পর কমলকুমারের উপন্যাসগুলি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধার করেন তাঁর স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদার। তিনি স্বয়ং বিদুষী এবং সুলেখিকা। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে সধবা অবস্থায় তাঁর এই সব পরিচয় কিছুই জানা যায়নি, তিনি ছিলেন অন্তরালবুর্তিনী। এমনকী কমলকুমার তাঁর প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি পত্নীকে উৎসর্গ করলেও সেখানে সহধর্মিণীর নাম উল্লেখ করেননি, শুধু লিখেছিলেন স্ত্রীকে।
খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় লেখেননি কমলকুমার, অর্থের জন্য তো নয়ই। এক্ষণ পত্রিকায় সম্মান দক্ষিণা দেবার রেওয়াজ ছিল না, কমলকুমার কিছু পেয়েছিলেন কি না জানি না। কৃত্তিবাস পত্রিকা থেকে তিনি একবারই চেয়ে নিয়েছিলেন মাত্র তিরিশ টাকা। (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, যে গুটিকয়েক ছাত্রকে তিনি ফরাসি ভাষা শিক্ষা দিতেন, তাদের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা নিতেন মাসিক একটাকা।)
তবে কমলকুমারের সাহিত্য রচনার প্রেরণা কী ছিল? তিনি ছিলেন উত্তম পড়ুয়া, তাঁর সময়ে, একশো বছরের বাংলা গদ্য সাহিত্য ছিল তাঁর নখদর্পণে, বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বঙ্কিম এবং রাজশেখর বসুর, এই ভাষার ঐশ্বর্য নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল, তবু কিছু একটা অভাববোধও ছিল। ধনী ভাষাগুলির সাহিত্য ঠিক একমুখী হয় না। অনেকগুলি ধারা থাকে, বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঘটনা পরম্পরার ধারাটিই অতি প্রবল, অন্য আর কোনো ধারাই নেই বলতে গেলে। বাস্তব কখনো উত্তীর্ণ হয়নি পরা বাস্তবতায়। লোককথা, রূপকথা, প্রবাদ, ছড়া, হেঁয়ালি ইত্যাদির মধ্যেও থাকে যে সব লুক্কায়িত কাহিনী, সেগুলিও যে আধুনিক সাহিত্যের অন্তর্গত হতে পারে, তা নিয়ে পরীক্ষা হয়নি বিশেষ।
সেইজন্যই কমলকুমার শুধু সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হননি, তিনি নতুন ধারার প্রবর্তনে উদ্যত হয়েছিলেন, তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বাংলা সাহিত্যে এসে পড়েছে আচম্বিতে, এর কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, এই গদ্যরীতি ও কাহিনী বিন্যাস সম্পূর্ণ অভিনব। এরকম রচনার আস্বাদের জন্য বাংলার পাঠকরা দীক্ষিত নয়, সেইজন্যই কমলকুমার হয়তো আশা করেছিলেন, ছোট সাহিত্য পত্রিকার যে একটি নির্বাচিত পাঠকগোষ্ঠী থাকে, যাদের অধিকাংশই সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী তারা অন্তত অনুধাবন করার চেষ্টা করবে। আমার মনে আছে, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ প্রকাশিত হয়েছিল একটি অল্প পরিচিত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায়, কমলকুমার সেই পত্রিকাটি থেকে নিজের উপন্যাস-অংশ ছিঁড়ে নিয়ে, বেশ কিছু কপি আলাদা ভাবে সেলাই করে কিছু নবীন লেখককে উপহার দিয়েছিলেন এবং আমাকে দশ-বারোটি কপি দিয়ে বলেছিলেন, অন্য লেখকদের মধ্যে বিলি করে দিও, তারা পড়লেই আমি খুশি।