মজনুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল মরনি। গিরস্তালি করা বহুত কষ্টের বাজান। এত কষ্ট তুই করতে পারতি না।
ক্যান পারুম না? আমি বড় অইছি না?
কত বড় আর অইছস!
আঠরো বচ্ছর বয়স অইছে, কম মনে করোনি তুমি?
খোলা থেকে আরেকটা পিঠা নামাল মরনি। নীল রঙের ময়লা নোংরা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল। চুলার পারে বসলে শীতকালেও মুখে গলায় ঘাম জমে। সেই ঘাম মুছল মরনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ তর বয়স পুরা আঠরো বচ্ছর। কোন ফাঁকে যে দিন গেলগা উদিস পাইলাম না। আমার খালি মনে অয় এই তো হেদিনকার কথা। তর মার বিয়ার আষ্ট মাস পর আমার বিয়া অইলো। আমি খালি এই সংসারে আইছি, তর মার আহুজ পড়বো (বাচ্চা হবে)। তগো বাইত্তে গেলাম বুজির লগে থাকনের লেইগা। আহুজ পড়নের সমায় দেশ গেরামের বউঝিরা বাপের বাইত্তে আহে, মা বইনের কাছে থাকে। আমগো তো মা বাপ আছিলো না, ভাই আছিলো না। তিন বইন আমরা মামাগো সংসারে বড় অইছি। আমি যহন খুব ছোড তহন বড়বুজির বিয়া অইছে। জামাই থাকে ফরিদপুর। বড়বুজি ফরিদপুর গেল গা। পাঁচছয় বচ্ছরে একবার নাইওর আইতো। তর মায় মরণের আগে, আমার বিয়ার সমায় বড়বুজিরে শেষ দেখছি। তার বাদে হে আর আহে নাই। তর মার মরণের সমবাদ পাইয়াও আহে নাই।
কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে গেল মরনি। খোলায় শেষ পিঠা বসিয়েছে। এখন পিঠার দিকেও খেয়াল নাই।
রান্নাচালার পিছনে ঝাপড়ানো একটা জামগাছ। সকালবেলার রোদে চকচক করছে জামপাতা। একটা টুনটুনি পাখি লাফাচ্ছে গাছের ডালে। এই ডাল থেকে ওই ডালে যায় টুনটুনি, ওই ডাল থেকে সেই ডালে। জামগাছটার দিকে তাকায় মরনি ঠিকই পাখিটা দেখেও দেখে না। মনের ভিতর অতীত দিনের স্মৃতি। চোখ জুড়ে অতীত দিনের প্রিয় মানুষের মুখ।
উদাসীন গলায় মরনি বলল, বড়বুজির চেহারাডাও অহন আর মনে নাই। তর মায় মইরা সইরা গেছে, বড়বুজি বাইচ্চা থাইক্কাও সইরা গেছে। হেয়ও অহন মরা। তিন বইন একলগে গলা প্যাচাপেচি কইরা বড় অইছিলাম, দিন গেল, তিনজন তিনমিহি সইরা গেলাম। একজন মইরা সরলো আর দুইজন বাইচ্চা। আতকা বড়বুজিরে দেকলে আমি মনে অয় হেরে অহন চিনতে পারুম না। হেয়ও চিনতে পারবো না আমারে। সমায় এমুন কইরা আপনা মাইনষেরে পর বানাইয়া দেয়, অচিন বানাইয়া দেয়!
তিনখান পিঠা খেয়ে টিনের গেলাসে ঢক ঢক করে এক গেলাস পানি খেল মজনু। শেষ পিঠাটা তখনই খোলা থেকে নামাল মরনি। দেখে মজনুর মনে পড়ল সকালবেলা এখনও কিছু মুখে দেয়নি খালা। পিঠা ভেজে তাকে খাওয়াচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে গল্প করছে। তিনখান পিঠা খেয়ে তার পেট ঢোল আর খালা এখনও খালি পেটে। ব্যস্ত গলায় মজনু বলল, তুমি দিহি কিছু খাইলা না?
মরনি হাসল। বিয়ানে আমার কিছু খাইতে ইচ্ছা করে না। খিদা লাগে না।
আমার লগে মিছাকথা কইয়ো না খালা। বিয়ানে মাইনষের খিদা না লাইগ্যা পারে?
পারে বাজান, পারে। বহুদিন পর ঘরের পোলা ঘরে ফিরা আইলে মার পেড এমতেঐ ভইরা থাকে। বিয়ানে দোফরে রাইত্রে কিছু না খাইলেও খিদা লাগে না। এতদিন পর তুই যে আমার সামনে বইয়া খাইলি এইয়া দেইক্কাই আমার খাওয়া অইয়া গেছে। পেড ভইরা গেছে।
মরনির কথা শুনে আবার চোখ ছলছল করে উঠল মজনুর। আবার অন্যদিকে মুখ ফিরাল সে। এই ফাঁকে চুলার জ্বাল নিভিয়ে জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগল মরনি। পিঠাগুলি মাটির বাসনে রাখতে রাখতে বলল, আফাজদ্দি খলিফা মানুষ কেমুন?
মজনু কথা বলল না। খালার দিকে তাকালও না। যেমন অন্যদিকে তাকিয়েছিল তাকিয়ে রইল।
মরনি অবাক হল। মজনুর কাঁধের কাছে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলল, কী অইলো বাজান, কথা কচ না ক্যা? ব্যাজার অইছস ক্যা?
এবার খালার দিকে মুখ ফিরাল মজনু। ছলছল চোখে অবুঝ গলায় বলল, অমু না? ব্যাজার অমু না? অহনও কি ভাদ্দর আশ্বিন মাস? অহনও কি আমি ছোডঃ?
হায়রে পাগল পোলা, আমারে তুই কী করতে কচ?
আমার সামনে বইয়া পিডা খাইবা তুমি। অহনে খাইবা, দোফরে খাইবা। রাইত্রে আমার লগে বইয়া ভাত খাইবা। আমি যতদিন দেশে থাকুম আমার লগে বইয়াঐ তিন ওক্ত খাওন লাগবো তোমার। যুদি না খাও আমিও খামু না। আমি ঢাকা যামু গা।
মরনি কথা বলে না। অদ্ভুত চোখ করে মজনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হাত বাড়িয়ে খালার একটা হাত ধরল মজনু। চাইর মাসে খলিফা কাম আমি ভালঐ হিগছি। হাতের কাম পুরাপুরি হিগছি, কাটিংও হিগছি কয়খান। ফিরা গিয়া মিশিনে বমু। আফাজ মামায় কইছিলো আর দুই মাস পর বাইত্তে যা, তহন তুই পুরা খলিফা অইয়া যাবি। অহন তো থাকন খাওন বাদ দিয়া দুইশো টেকা পাছ, দুই মাস বাদে পাবি চাইরশো। একবারে কিছু টেকা লইয়া খালার লগে দেহা করতে যাই। আমি কইলাম, না আমি অহন যামু। খালারে এতদিন না দেইক্কা আমি কোনওদিন থাকি নাই। মিশিনে বহনের আগে খালার মুখখানা ইট্টু দেইক্কাহি (দেখে আসি)।
মজনুর কথা শুনতে শুনতে শেষদিকে দিশাহারা হয়ে গেল মরনি। গভীর আনন্দের গলায় প্রায় চিৎকার করে উঠল। তর মায়না অইছে বাজান, অ্যা? দুইশো টেকা মায়না অইছে? কবে থিকা মায়না অইছে? কাইল বিয়ালে বাইত্তে আইলি, একটা রাইত গেল, তুই দিহি আমারে কিছু কইলি না?
মজনু নির্মল মুখ করে হাসল। তোমারে দেইক্কা আমার আর কিছু মনে আছিলো না খালা। সন্দা অইতে না অইতে ভাত খাইয়া তোমার কুলের কাছে হুইয়া ঘুমাইয়া গেলাম। হারা রাইত আর উদিস পাইলাম না। বিয়ানে উইট্টা মনে অইলো চাইর মাস বাদে ঘুমাইলাম। কাইল সন্দায় তোমার সামনে বইয়া ভাত খাইয়াও মনে অইলো চাইর মাস বাদে ভাত খাইলাম।