এসব ভেবে দ্রুত পা চালাচ্ছে বুড়ি, মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণে এসেছে, বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যে লম্বা টোসখোলা ঝোপ সেই ঝোপের এই পাশ থেকে হেলেপড়া খাজুর গাছটার পায়ের কাছে ছানিপড়া চোখে একটা লোককে বসে থাকতে দেখল। দেখে থমকে দাঁড়াল। গলা টানা দিয়ে কলল, কেডারে খাজুরতলায়?
খাজুরতলা থেকে সাড়া এল। আমি।
আমি কে?
মানুষটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাসি মুখে আমোদর গলায় বলল, কও তো কেডা?
বয়সী মাথা কাঁপাল ছনুবুড়ি। গলাডা চিনা চিনা লাগে!
তারপরই উচ্ছল হল। চিনছি। দউবরা। ঐ দউবরা খাজুরতলায় কী করচ তুই? গাছ ঝুড়ছ?
না অহনও ঝুড়ি না। যন্ত্রপাতি লইয়া বাইর অইছি। আইজ ঘুইরা ঘাইরা গাছ দেকতাছি। কাইল পশশু ঝুড়ম। তুমি আইলা কই থিকা?
জাহিদ খাঁর বাইত্তে দাওত খাইতে গেছিলাম।
কেডা দাওত দিলো তোমারে?
জাহিদ খাঁর বড়পোলায়। পোলার বউডা এত ভাল, দুই একদিন পর পরঐ দাওত দিয়া খাওয়ায় আমারে। কয় আমারে বলে অর মার মতন লাগে।
ছনুবুড়ির কথা শুনে হাসল দবির। কী খাওয়াইল?
ভাত আর চাইর পাঁচপদের মাছ। ইলসা, টাটকিনি, গজার। বাইং মাছও আছিলো। আমি খাই নাই। শ্যাষমেষ দিল দুদ আর খাজুরা মিডাই (খেজুরে গুড়)।
অহন খাজুরা মিডাই পাইলো কই?
আরবছরের মুড়ির জেরে (টিনে) রাইক্কা দিছিলো।
তারপর দবিরকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, বউডা এত ভাল বুজলি দউবরা, গাছের বাইগন, বিলাতি বাইগন (টমেটো) অহনও ডাঙ্গর হয় নাই, হেইডিও কতডি ছিড়া আমার টুপরে দিয়া দিল। কইলো বাইত্তে লইয়া যান। হাজামবাড়ি গেছি তামুক খাইতে, আমার টুপুর দেইক্কা তছি পাগলনী কয় কি, কী চুরি করলা! ক আমি বলে চোর!
ছনুবুড়ির স্বভাব জানার পরও তছির উপর রাগল দবির। বলল, বাদ দেও পাগল ছাগলের কথা। অর কথায় কী যায় আহে!
ছনুবুড়ি খুশি হয়ে বলল, হ, অর কথায় কী যায় আহে। তুই একখান কাম করিচ বাজান, পয়লা দিনের রস আমারে ইট্টু খাওয়াইচ।
খাওয়ামুনে। দুই চাইরদিন দেরি অইবো।
ক্যা, দেরি অইবো ক্যা?
গাছ ঝুইড়া ঠিল্লা পাততে সময় লাগবো না! উততইরা বাতাসটা আইজ খালি ছাড়ছে। আইজ থিকা রস আইছে গাছে। বেবাক কিছু ভাও করতে দুই তিনদিন লাগবো। পয়লা দিনের রস খাওয়ামুনে তোমারে, চিন্তা কইরো না। অহন খালি দেহ উততইরা বাতাসটা কেমনে ছাড়ছে! এইবারের রস দেখবা কেমুন মিডা অয়!
বিকাল শেষের উত্তরের হাওয়ায় ছনুবুড়ির পাটের আঁশের মতো চুল তখন ফুর ফুর করে উড়ছে। এই হাওয়ায় মনে কোনও পাপ থাকে না মানুষের, কূটনামী থাকে না কিন্তু ছনুবুড়ির মনে সামান্য কূটবুদ্ধি খেলা করতে লাগল।
১.০৬-১০ রান্নাচালার সামনে
১.০৬
রান্নাচালার সামনে আমকাঠের সিঁড়ি পেতে বসেছে মজনু। সকাল বেলার রোদ পাকা ডালিমের মতো ফেটে পড়েছে চারদিকে। এই রোদের একটা টুকরা ছিটকে এসে পড়েছে মজনুর ছোটখালা মরনির মুখের একপাশে। মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেছে তার। মজনু অপলক চোখে তাকিয়ে আছে খালার মুখের দিকে। দুনিয়াতে এই একটা মাত্র মুখ যে মুখের দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে সে। আর কিছুর দরকার হয় না।
মাটির খোলায় মরনি এখন চিতইপিঠা ভাজছে। চুলার ভিতর চুটপুট চুটপুট করে জ্বলছে নাড়ার আগুন। রোদ নাড়ার আগুন মিলেমিশে হেমন্ত সকালের শীতভাব বিদায় করে দিয়েছে। রান্নাচালার চারপাশে বেশ একটা আরামদায়ক ভাব। লগে আছে চিতইপিঠা ভাজার গন্ধ। সব মিলিয়ে ভারি সুন্দর পরিবেশ। এই পরিবেশের কিছুই উদিস পাচ্ছে না মজনু। সে তাকিয়ে আছে খালার মুখের দিকে।
খোলা থেকে লোহার চটায় যত্ন করে প্রথম পিঠাটা তুলল মরনি। হাতের কাছে রাখা ছোট্ট বেতের ডালায় পিঠা নিয়ে মজনুর দিকে এগিয়ে দিল। নে বাজান খা। চিতই। পিডা গরম গরম না খাইলে সাদ (স্বাদ) লাগে না।
কথা বলতে বলতে মজনুর দিকে তাকিয়েছে মরনি, তাকিয়ে দেখে মজনু একদৃষ্টে চোখে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। মরনি অবাক হল। কীরে, এমতে চাইয়া রইছস ক্যা?
মজনু চোখ নামাল, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এমতেঐ। অনেকদিন তোমারে দেহি না তো, ইট্টু দেকলাম।
একথায় মরনির বুকের ভিতর উথাল দিয়ে ওঠে মায়ের আদর। সে যে মজনুর মা না, খালা একথা তার মনে থাকে না। ডানহাত বাড়িয়ে মা যেমন কখনও কখনও তার সন্তানকে আদর করে ঠিক সেই ভঙ্গিতে মজনুর গালে মুখে একটা হাত বুলাল। আমিও তো তরে দেহি না বাজান। আমিও তো তর মুখটা কতদিন দেহি না। তরে না দেইক্কা এতদিন আমি কোনওদিন থাকি নাই।
আমি থাকছি?
না তুইই বা থাকবি কই থিকা! তর মায় মইরা যাওনের পরঐত্তো তরে আমি কুলে কইরা লইয়াইলাম। তারপর থিকা তুই আমার পোলা। আইজ সতরো আঠরো বচ্ছর তরে আমি চোখখের আঐল (আড়াল) করি নাই।
একথায় অদ্ভুত এক অভিমানে বুক ভরে গেল মজনুর। মুখ গোমড়া করে বলল, তাইলে অহন করছো ক্যান? ক্যান আমারে খলিফা (দর্জি) কামে দিলা? ক্যান আমারে টাউনে পাডাইলা?
মরনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খাদা (মাটির যে পাত্র ভাতের ফ্যান ঢালার কাজে ব্যবহৃত হয়) থেকে পাতলা করে গোলানো চাউলবাটা নারকেলের আইচায় (মালা) তৈরি হাতায় পরিমাণ মতো তুলে যত্ন করে ঢালল গরম খোলায়। লগে লগে ফুলে ফেপে চিতইপিঠার আকার ধরল জিনিসটা। মজনুর মুখের দিকে আর তাকাল না মরনি। অসহায় গলায় বলল, না পাডাইয়া কী করুম ক! তুই বড় অইছস না? কাম কাইজ হিগবি না? নাইলে খাবি কী কইরা?