ছিয়ানব্বই সালে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স তাড়া দিতে লাগল, তারা আমার উপন্যাস ছাপবে, এবং তাদের পছন্দ নূরজাহান। কিন্তু উপন্যাস তো শেষ হয়নি। আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু বললেন, যেহেতু বড় উপন্যাস, আমরা দু’খণ্ড করে ছাপব। সুনীলের ‘সেই সময়’ কিংবা ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এর মতো। দ্বিতীয় পর্ব পড়ার আগ্রহ যেন পাঠকের থাকে এরকম একটি পর্যায়ে এনে ‘নূরজাহান’ আপাতত শেষ করলাম। প্রথম পর্বটি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু দ্বিতীয় পর্ব আর শুরু করতে পারি না। যদিও নূরজাহান আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমার মন জুড়ে, মাথা জুড়ে রয়ে গেছে। প্রায়ই ভাবি শুরু করব। পাঠকরা, বন্ধু সুহৃদরা। তাগিদ দিচ্ছে। শুরু আর করা হয় না। একটি-দুটি করে বছর চলে যায়। শেষ পর্যন্ত আবার ধারাবাহিক ভাবে শুরু করলাম জনকণ্ঠের সাহিত্য পাতায়। অনেকগুলো কিস্তি লেখার পর। আচমকা বন্ধ করে দিলাম। তেমন কোনও কারণ নেই। অযথাই। তারপর আবার একটি বছর কাটল। তারপর ভাবলাম, না, এবার শেষ করবই। কিন্তু আর ধারাবাহিক না, একটানা। লিখে শেষ করব। ভিন্ন ভিন্ন নামে তিনটা পার্ট লিখলাম ইদসংখ্যায়। বাবুই পাখির জীবন (অন্যদিন) কাঁচা বাঁশের পালকি (প্রথম আলো) জনকণ্ঠের পাক্ষিকেও একটা পার্ট ছাপা হল, সেই পার্টের নাম ভুলে গেছি। যা হোক, তারপরও দেখি, কী আশ্চর্য, নূরজাহান তো শেষ হয়নি। আসল অংশটাই রয়ে গেছে! তৃতীয় পর্ব লিখতে হবে!
২০০২ এর ডিসেম্বরে বেরুল দ্বিতীয় পর্ব। তার ৭/৮ বছর পর শুরু করলাম শেষ পর্ব। সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হল ১৭/১৮ কিস্তি। তারপর বন্ধ। লেখা। আগায় না। ওই ১৭/১৮ কিস্তি একত্র করে ‘সমকাল পত্রিকার ইদসংখ্যা ২০১০ ছাপা হল। এদিকে প্রতি বছর বইমেলায় পাঠক শেষ পর্বের খোঁজ করেন। কেউ কেউ মন খারাপ। করেন। বন্ধুরা রাগারাগি করে। কলকাতার এক ভদ্রলোক, তাঁর নাম তরুণ বসু প্রায়ই ফোন করেন। কোত্থেকে আমার ফোন নম্বর পেয়েছেন জানি না। বলেন দুটো পর্ব পড়ে বসে আছি, শেষ পর্ব কবে শেষ করবেন। তরুণ বসু যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ড. মলয়কিশোর চৌধুরী থাকেন দিল্লিতে। তিনি শেষ পর্বের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর হয়ে তরুণ বসু নিয়মিত আমাকে তাগিদ দিচ্ছেন। আমি গুছিয়ে লিখতেই পারছি না।
শেষ পর্যন্ত ২০১০-এর মাঝামাঝি একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, না, নূরজাহান শেষ পর্ব না লিখে অন্য একটি লাইনও লিখব না। অন্য সব কাজ বন্ধ। লিখতে বসে দেখি প্রথম দুই পর্বের অনেক ঘটনা, অনেক চরিত্রের নাম ভুলে গেছি। তাদের পেশা জীবনযাপন প্রণালী মনে নেই। প্রথম দুটো পর্বের পৃষ্ঠা সংখ্যা সাতশোর মতো। পড়তে শুরু করলাম। পড়তে গিয়ে পড়লাম আরেক ঝামেলায়। কোনও কোনও অংশ পছন্দ হয় না, শব্দ ব্যবহার ভাল লাগে না। মনে হয় বিক্রমপুর অঞ্চলের ভাষার ভিতরকার সুরটা ঠিক আসেনি। শুরু করলাম কাটাকুট্টি। সর্বনাশ! ওই করতে গিয়ে দেখি তারচে’ পুরো সাতশো পৃষ্ঠা নতুন করে লেখা সহজ ছিল। একদিকে ওই কাজ করছি আরেক দিকে শেষ পর্ব লিখছি। ছয়-সাতমাস লেগে গেল গুছিয়ে শেষ করতে। শেষ পর্ব শেষ করে খুব মন দিয়ে পড়লাম। পড়ে দেখি বিক্রমপুর অঞ্চলের ভাষার ভিতরকার সুরটা বোধহয় কিছুটা আসছে। শুধু সংলাপে না, লেখকের বর্ণনায়ও ঢুকে গেছে ওই অঞ্চলের শব্দ, সুর। আগের পর্ব দুটোতে অতটা আসেনি সেই সুর। তবে যেভাবে ভেবেছিলাম অনেকটাই সেইভাবে লিখতে পেরেছি। আর এই ছয়-সাত মাসে বাড়ির পরিবেশ, বাচ্চাকাচ্চা আর তাদের মা’কে চূড়ান্ত জ্বালাতন করেছি। অকারণ ধমকা ধমকি, রাগারাগি, বিরক্তি। অর্থাৎ কোনও কোনওদিন লিখতে না পারার ঝাল যেন তাদের ওপর মিটাচ্ছি। আমার ছোট মেয়েটি একদিন বলল, লেখকরা হন শান্ত স্নিগ্ধ সুন্দর মানুষ। তাদেরকে দেখলে শান্তি লাগে, তোমাকে দেখলে লাগে অশান্তি!
অশান্তি লাগবারই কথা। কারণ আমার নিজের ভিতরে তখন অন্য আরেক অশান্তি। মনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উপন্যাস শেষ হয়েছে। এতদিনকার সঙ্গী নূরজাহান আমাকে ছেড়ে গেছে। এতগুলো বছর ধরে, এতগুলো দিন প্রায় ১২০০ পৃষ্ঠা জুড়ে যে আমার সঙ্গে ছিল সে এখন নেই। তার জন্য বুকের ভিতরটা হাহাকার করে।
নূরজাহান লেখার জন্য কিছু বইপত্র পড়তে হয়েছিল। সব বই আর পত্র-পত্রিকার নাম দেওয়া গেল না। কিছু বই আর রিপোর্ট ইত্যাদির তালিকা দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
.
যেসব বই ও পত্র-পত্রিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে
১. কোরানশরিফ সরল বঙ্গানুবাদ-মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
২. কুরআন শরীফ-ভাই গিরিশচন্দ্র সেন
৩. কোরানসূত্র-মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
৪. প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-শিশির দাস
৫. বুখারী শরীফ বঙ্গানুবাদ-মূল : হযরত আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী (রহঃ) অনুবাদ-শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক সাহেব
৬. পবিত্র বাইবেল (পুরাতন ও নূতন নিয়ম)
৭. ইঞ্জিল শরীফ
৮. বাইবেল অভিধান।
৯. হাদীসের বাণী-আবুল ফজল
১০. কুরআনের বাণী-আবুল ফজল
১১. কাবা শরীফের ইতিহাস-ফিরোজ আহমদ চৌধুরী
১২. মহানবী (সাঃ) এর জীবনচরিত-এইচ. এম. হায়কল