অনেকটা এরকমভাবেই লেখা হয়েছিল ‘পরাধীনতা’। লেখার আগে শুধু একটি লাইন মাথায় ছিল, ‘আমার কোনও রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই।’ লেখা শেষ হওয়ার পর দেখি ওটা হচ্ছে উপন্যাসের শেষ লাইন।
নূরজাহান লেখার আগে আমার নিজের লেখা সবচাইতে প্রিয় উপন্যাস ছিল পরাধীনতা। একাশির শেষদিকে জার্মানি থেকে ফিরে এসে লিখেছিলাম। বিরাশি সালের ইদসংখ্যা রোববারে ছাপা হয়। মনে হয় এই তো সেইদিনের কথা, কিন্তু কত কত বছর হয়ে গেছে।
আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ও আমার একটি প্রিয় উপন্যাস। ছিয়াত্তর সালে লেখা যাবজ্জীবনে যুদ্ধবাক্যের ভেতর অবলীলাক্রমে মুনশিগঞ্জ-বিক্রমপুরের আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছিলাম। সেই কায়দায় এখন কোনও কোনও তরুণ লেখককে লিখতে দেখি। আমার মজাই লাগে।
মুনশিগঞ্জ-বিক্রমপুর অঞ্চলের ভাষাটি আমার বেশ পছন্দের। এই ভাষায় একটি পুরো উপন্যাস লিখেছিলাম। ‘কালাকাল’। ‘যাবজ্জীবন’ এবং ‘কালাকাল’ ছাপা হয়েছিল বাংলা অ্যাকাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায়। নিজের গ্রামজীবন নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলোই আমার বেশি পছন্দের। যেমন ‘ভূমিপুত্র’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘রূপনগর’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ভূমিকা’, ‘অধিবাস’, ‘মৌসুমি’, ‘বাঁকা জল’ আর ‘নূরজাহান’।
খুব গুছিয়ে গাছিয়ে, আয়োজন এবং পরিকল্পনা করে আমি কখনও লিখতে পারি না। আচমকাই একটা লেখা শুরু করি। নূরজাহানও এভাবেই শুরু করেছিলাম। তিরানব্বই সালের কথা। বাংলা অ্যাকাডেমির বইমেলায় বিনোদন নামের একটি স্টলে বসি। স্টলটি ছিল শুধুমাত্র আমার বইয়ের। তিনটি কারণে তিরানব্বই সালটি আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি সেবছর বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেলাম, আমার একটি প্রেমের উপন্যাস ‘ভালবাসার সুখ দুঃখ’ বইমেলার পুরো একমাসে পঁয়ত্রিশ হাজার কপি বিক্রি হল, সারা বছরে বিক্রি হল পঁয়ষট্টি হাজার কপি আর আমি ‘নূরজাহান’ লিখতে শুরু করলাম।
বিনোদনের স্টলে প্রায়ই আমার কাছে একজন সাংবাদিক আসতেন। অল্পবয়সি একটি ছেলে। নাম শহিদুল ইসলাম মিন্টু। আজকের কাগজ গ্রুপের সাপ্তাহিক খবরের কাগজে কাজ করে। একটু গম্ভীর ধরনের চুপচাপ স্বভাবের ছেলে কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ তেজি। কী যেন কী কারণে মিন্টু আমাকে খুব পছন্দ করে ফেলল। তাদের কাগজে আমাকে বলল ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে। কিছু না ভেবে রাজিও হলাম। কিন্তু কী লিখব জানি না।
এসবের বেশ কিছুদিন আগ থেকে বাংলাদেশ উত্তপ্ত হয়েছিল নূরজাহানের ঘটনায়। মৌলভিবাজারের ছাতকছড়ায় দ্বিতীয় বিয়ের অপরাধে গ্রাম্য মসজিদের ইমাম মান্নান মাওলানা ফতোয়াজারি করল, নূরজাহানকে বুক অবদি মাটিতে পুঁতে তার ওপর একশো
একটি পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। করলও তাই। সেই অপমানে আত্মহত্যা করল নূরজাহান। ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন তুলল।
মিন্টু আমাকে বলল, নূরজাহানকে নিয়ে উপন্যাস লেখেন।
এর আগে শবমেহেরকে নিয়ে বিচিত্রার ইদসংখ্যায় উপন্যাস লিখেছিলাম। শবমেহের ছিল এক গ্রাম্য কিশোরী। পতিতাপল্লির নারীদালালের মাধ্যমে গ্রাম থেকে টানবাজারের পতিতাপল্লিতে পাচার হয়ে এসেছিল সে। কিন্তু কিছুতেই পতিতাবৃত্তিতে রাজি হয়নি। ফলে তার ওপর নেমে এসেছিল নির্মমতা। পিটাতে পিটাতে মেরে ফেলা হয়েছিল শবমেহেরকে। আমি উপন্যাসের নাম দিয়েছিলাম ‘টোপ’। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত আমার উপন্যাস সংকলন ‘মাটি ও মানুষের উপাখ্যান’-এ সংকলিত হয়েছে ‘টোপ’।
শবমেহেরকে নিয়ে লেখা উপন্যাসটির কথা বোধহয় মিন্টুর মনে ছিল। সেই ধারণা থেকেই নূরজাহানের কথা বলল সে। আইডিয়াটা পছন্দ হল আমার। বিনোদনের স্টলে বসেই উপন্যাসের নাম ঠিক হল ‘নূরজাহান’। পরের সংখ্যায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দিল মিন্টু, আগামী সংখ্যা থেকে শুরু হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু নূরজাহানের ঘটনাটা ঘটেছিল মৌলভিবাজারে, অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলে। সেই অঞ্চলের ভাষা তো আমার জানা নেই। আমি জানি মুনশিগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাষা। বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে আমার ছেলেবেলার কয়েকটা বছর কেটেছে।
নুরজাহানকে আমি বিক্রমপুরে নিয়ে এলাম, মেদিনীমণ্ডল গ্রামে। যে গ্রামের ওপর দিয়ে যাচ্ছে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক। একটি সড়কের কল্যাণে প্রায় রাতারাতি বদলে যাচ্ছে বহু বহু বছরের পুরনো গ্রামগুলো, বদলে যাচ্ছে মানুষ। সড়কের কাজে আসা নতুন নতুন মানুষে ভরে যাচ্ছে দেশগ্রাম। এই পরিবেশে এনে নূরজাহানকে আমি ছেড়ে দিলাম। উপন্যাস শুরু হল হেমন্তের শেষদিকে, যেদিন প্রথম বইতে শুরু করল উত্তুরে হাওয়া। নূরজাহানকে ঘিরে একে একে এল অনেক চরিত্র। দবিরগাছি, হামিদা, মরনি, মান্নান মাওলানা, আলী আমজাদ, মাকুন্দা কাশেম, ছনুবুড়ি। শুধু নূরজাহানের আদলটা আমি রাখলাম, মূল ঘটনা মাথায় রাখলাম, রেখে লিখতে লাগলাম নিজের মতো করে। লিখতে লিখতে দেখি চরিত্রগুলো একসময় নিজেদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করছে, কথা বলছে। ঘটনার পর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যেন লেখকের অজান্তেই। কোনও কিছুই যেন বলাতে হচ্ছে না আমাকে। কোথায় এসে যে বাস্তবের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কল্পনা, শুদ্ধবাক্যের ভেতর কেমন কেমন করে যে ঢুকে যাচ্ছে আঞ্চলিক শব্দ, বিক্রমপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য, সাধারণ। মানুষের জীবনযাপনের ছবি আর বেঁচে থাকার স্বপ্ন সব মিলেমিশে লিখতে বসলেই টের পাই আমার ভেতর যেন তৈরি হয়েছে আশ্চর্য এক ঘোর। আমি যেন ঘোরের মধ্যে লিখছি, বাস্তব যেন লুপ্ত হয়ে গেছে। এইভাবে দু-আড়াই বছর ধরে লিখে দেখি, না, লেখা তো শেষ। হয় না। আরও কত যেন রয়ে গেল।