হালটের মাঝামাঝি আসছে, বাদলা হঠাৎ নাদের হামেদ আলালদ্দি বারেককে বলল, ল চাকাই শালারে! নূরজাহান বুজিরে ওই শালায় যেমনে ইটাইছিল, এহেনে তো ইটা নাই, খেতের চাকা আছে, চাকাই শালারে।
নাদের বলল, পুলিশে কিছু কইবো না?
কইলে দৌড় দিমু।
বারেক বলল, তয় ল।
পায়ের কাছ থেকে বড় একটা শক্ত মাটির চাকা তুইলা মান্নান মাওলানার মুখ বরাবর ফিক্কা মারল বাদলা। ধাম কইরা সেই চাকা আইসা লাগল মান্নান মাওলানার দুই ঠোঁটের মাঝখানে। সে একেবারে হকচকাইয়া গেল। এই কেডারে, কেডা চাকায়?
পুলিশ কনেস্টবলরাও লইড়া চইড়া উঠল। পোলাপানদের ধমক দিতে যাবে, ওয়াজিউল্লাহ তাদের দিকে তাকায়া চোখ টিব দিল। কিছু বোলো না। ঢিলাক শালারে।
তারপর বাদলার দিকে তাকায়া নিঃশব্দে হাত ইশারা দিল।
আর কথা নাই। হালটের দুই পাশ থেকে তুমুল ক্রোধে বৃষ্টির মতন চাকা পড়তে লাগল মান্নান মাওলানার মুখে। হাত তুইলা, মুখ নিচা কইরা, চিৎকার চেঁচামেচি কইরা নানান ভাবে পোলাপানের চাকার হাত থেকে নিজেরে রক্ষা করতে চাইল, পারল না। ঠাকুরবাড়িতে মেয়েদের কলেজ করার কাজ অনেকটা আগায়া আনছেন খানবাড়ির কর্তারা। ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা হইয়া গেছে। ইলেকট্রিকের খাম্বা বসানের লেইগা হালটের মাঝবরাবর একপাশে বড় একটা গর্ত করা হইছে। নিজেরে পোলাপানের চাকার হাত থেকে বাঁচানের জন্য আঁকুপাকু করতে করতে সেই গর্তে পড়ল মান্নান মাওলানা। হুমড়ি খাইয়া পড়তে পড়তেও সোজা হইয়া খাড়ইল গর্তে। বৃষ্টির মতন চাকা সমানে চলছে তখন। মান্নান মাওলানার কপাল ফাইটা রক্ত পড়ছে, চক্ষু দুইখান ফুইলা ফাইটা অন্ধ হওয়ার উপক্রম, নাক থ্যাঁতলাইয়া গেছে, ঠোঁট কাইটা ঝুইলা পড়ছে, দুই-একটা দাঁতও বোধহয় পইড়া গেছে। তার সাদা দাড়ি রক্তে মেন্দির মতন লাল হইছে। টপটপ কইরা রক্ত পড়তাছে নাক দিয়া, গাল কপাল দিয়া। তার মুখ আর মান্নান মাওলানার মুখ মনে হয় না। মনে হয় মাকুন্দা কাশেমের সেই মাইর খাওয়া মুখ। গর্তে দাঁড়ানো তাকে আর মান্নান মাওলানা মনে হয় না। মনে হয় আইজ সে নিরীহ নিরপরাধ নূরজাহান আর দেশগ্রামের পোলাপানরা হইয়া গেছে মান্নান মাওলানা। তবে মান্নান মাওলানা ইটের টুকরা ছুঁইড়া শাস্তি দিছিল নিরপরাধ নূরজাহানকে আর আজ পোলাপানরা চাকা ছুঁইড়া শাস্তি দিতাছে প্রকৃত এক ভণ্ডকে, প্রকৃত এক শয়তান আর মানুষের মতন দেখতে এক শুয়োরকে।
.
দিনগুলি দিনের নিয়মে কেটে যায়, রাতগুলি কাটে রাতের নিয়মে। শীত যায়, খরালি যায়। বর্ষা যায়, বসন্ত যায়। কোনও কোনও রাত গভীর অন্ধকারের, কোনও কোনও রাত চাঁদের, জ্যোৎস্নার। মাঝিবাড়ির নামার দিককার শিমুল গাছে ফুল ফোটে ফাল্গুন চৈত্রমাসে। রাতেরবেলা শিমুল ফুলের মৃদু সুবাস থাকে হাওয়ায়। হয়তো সেইরাতে আকাশ উজ্জ্বল করে ওঠে চাঁদ। জ্যোত্সায় ভরে যায় চারদিককার পৃথিবী। উঠানে বসে অসহায় দবির হামিদা নূরজাহানের কবরের দিকে তাকায় তারপর তাকায় আকাশের দিকে। পরম করুণাময়। আল্লাহপাকের দরবারে আকুতি জানায়, আল্লাহ, আল্লাহগো, আমার মাইয়াটারে যে বাঁচতে দেয় নাই এই দুনিয়াতে তুমি তার বিচার কইরো। রোজ হাসরের দিন তুমি তার বিচার কইরো।
সেইসব জ্যোৎস্না রাতে পদ্মার দিক থেকে হু হু করে আসে হাওয়া। বাঁশঝাড় শনশন করে সেই হাওয়ায়। বাশের শুকনা পাতা ঝরে পড়ে নূরজাহানের কবরে।
ভাদাইম্মা কুকুরটা বসে থাকে কবরের পাশে।
-: শেষ :-
লেখকের বক্তব্য
মুনশিগঞ্জ-বিক্রমপুর অঞ্চলে কখনই ঘটেনি কোনও ফতোয়ার ঘটনা। কোনও ভণ্ড মাওলানা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, মিথ্যে বলে অত্যাচার করতে পারেনি কোনও নারীর ওপর। মুনশিগঞ্জ বিক্রমপুরে ভণ্ড মাওলানাদের কোনও জায়গা নেই। এই অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত সচেতন, ভণ্ডামি প্রশ্রয় দেয় না। মান্নান মাওলানার মতো কোনও ভণ্ড মুনশিগঞ্জ বিক্রমপুরের কোনও গ্রামে থাকলে সেই গ্রামের মানুষজন কিছুতেই তাকে গ্রামে থাকতে দিত না, সে যত ক্ষমতাবানই হোক। একথা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি। কারণ আমি ওই অঞ্চলের মানুষ। আমি আমার এলাকার মানুষদের চিনি। মেদিনীমণ্ডল গ্রামে জীবনের অনেকগুলো বছর আমার কেটেছে। ওই গ্রামের পবিত্র জল হাওয়া আর মানুষের ভালবাসায় আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম। আমার বুজি (নানি) আমাকে তাঁর আঁচলের ছায়ায় রেখে বড় করেছিলেন। ওইরকম মহীয়সী নারী এই জীবনে আমি আর দেখিনি। তাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলাম ‘কেমন আছো, সবুজপাতা। আর আমার নূরজাহান শেষ পর্ব সেই মহীয়সী নারীকে উৎসর্গ করলাম। আর নূরজাহান আসলে এক প্রতীকী চরিত্র। বাংলাদেশের যে-কোনও গ্রামেই তাকে নিয়ে আসা যায়।
বহুদিন ধরে ভেবেছি বিক্রমপুরের পটভূমিতে একটা বড় উপন্যাস লিখব। সেই লেখাই যে শেষ পর্যন্ত নূরজাহান’ হবে এটা বুঝতে পারিনি। কোথাকার মেয়ে নূরজাহান কেমন করে চলে এল বিক্রমপুরে, কেমন করে লেখা হল তার উপাখ্যান ভাবলে অবাক লাগে। লেখালেখির ব্যাপারটা মাঝে মাঝে অদ্ভুত মনে হয়। কখন, কেমন করে যে কোন লেখার বিষয় মাথায় আসে, কেমন করে যে লেখা হয়ে যায় লেখক নিজেও অনেক সময় তা বুঝতে পারেন না। নূরজাহান লেখার ব্যাপারটিও শুরুতে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। কবিতার মতো একটি লাইন হঠাৎ মাথায় এল, ‘শেষ হেমন্তের অপরাবেলায় উত্তুরে হাওয়াটা একদিন বইতে শুরু করল। তারপর ক্রমাগত লিখে গেলাম। শুধু নূরজাহান চরিত্রটিই মাথায় ছিল, অন্য চরিত্রগুলোর কথা জানতাম না। লিখতে লিখতে তৈরি হল তারা।