মোতালেবকে যা বলতে বলা হয় সে বলে তার চাইতে অনেক বেশি বাড়াইয়া। গতকাল আছরের পর মান্নান মাওলানারে ধরছে সে। হোনেন হুজুর, ভাইগনায় আমারে সোজা কইছে, আমি য্যান মজজিদের সামনে খাড়া করাইয়া পায়ের জুতা খুইল্লা আপনেরে পিডাই। তারবাদে আপনের পুটকিতে লাইখাইতে লাইখাইতে মজজিদ বাড়ি থিকা বাইর কইরা দেই। দেলরা বুজিও তাই কইছে। আপনে আমগো মজজিদ বাড়ি নাপাক কইরা ফালাইছেন। তারবাদেও আপনেরে আমি এক সপ্তাহ টাইম দিলাম। এই এক সপ্তায় আমি নতুন ইমাম ঠিক করুম। তারবাদে আপনের চেহারা য্যান এইমিহি না দেহি। বোজছেন আমার কথা।
মান্নান মাওলানা কোনও কথা বলেন নাই। মাথা নিচা কইরা খাড়াইয়া ছিলেন।
আজ সকালে ফজরের নামাজ শেষ কইরা মুসল্লিরা চইলা যাওয়ার পর মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহরে নিয়া বসছেন। শুকনা মুখে বললেন, ঘটনা খারাপ হইয়া গেছে। কেসমেস হইছে, পেপারে লেখা হইছে, যদিও আমি আতাহার আমরা সাংবাদিকগো পাত্তা দেই নাই, তাগো লগে কথা কই নাই…।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মনির সর্দার বলল, আমগো কাছেও আইছিল সাংবাদিকরা। সাফ কইয়া দিছি, হুজুরে যা করছে ঠিকঐ করছে। যান আপনেরা পেপারে লেখেন গিয়া। ওই হগল লেখালেখি দিয়া বাল অয়।
মান্নান মাওলানা মাথা নাড়লেন। না, এইবার মনে অয় ভেজাল অইবো। বহুত মানুষ লাইন্না গেছে। আমি একজনরে থানায় পাডাইছিলাম টেকা টোকা দিয়া লাইন করতে পারে নাই। তয় চেষ্টা সে চালাইয়া যাইতাছে। মনির, কয়দিন পলাইয়া পোলাইয়া থাকুমনি? দেশ স্বাধীন হওনের লগে লগে যেমতে পলাইয়া গেছিলাম গা, বহুত দিন পলাইয়া আছিলাম, অমতে পলামু? দুই চাইর ছয়মাসে তো বেবাক ঠান্ডা অইয়া যাইবো। তারবাদে ফিরত আইলাম। স্বাধীনতার পর যেমতে ফিরত আইছিলাম।
নিয়ামতউল্লাহ বলল, আরে না হুজুর। আপনে এত ডরাইয়েন না। কিছু অইবো না। আমগো হাতে টেকা আছে, মানুষ আছে, ডরের কিছু নাই। বেবাক সামাল দিয়া হালামু। আপনে চুপচাপ বইয়া থাকেন। যেমতে ইমামতি করতাছেন করেন। কেউ নূরজাহানির বিষয়ে কিছু জিগাইলে কইবেন, যা করছি ঠিক করছি। আমি আল্লার খাসবান্দা। শরিয়ত মোতাবেক বিচার করছি। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমি কেঐরে ডরাই না।
নিয়ামতউল্লাহর কথায় ভরসা পাইলেন মান্নান মাওলানা। হ, আতাহারও আমারে হেইডাঐ কইছে। পশশুদিন ও গেছে গাদ্দ। হৌরবাড়ি কয়দিন বেড়াইবো। পোলাডা বাইত্তে নাই দেইক্কা সাহস কইম্মা গেছে। নিয়ামতউল্লাহ বলল, ওই দেহো হুজুরে কয় কী? আরে আতাহার বাজানে না আছে কী অইছে, আমরা আছি! আমরা থাকতে আপনেরে কেঐ কিছু করতে পারবো? এই মজজিদের ইমামতি আপনে না করলেন, মজজিদ একখান আপনের বাইত্তে আমরা বানাইয়া দিমু। মজজিদ বানানের টেকা আমরা কামাইয়া হালাইছি। আমরা আছি আপনের লগে। লন চা বিস্কুট খাই।
কামালের দোকানে আইসা চা বিস্কুটের অর্ডার মাত্র দিছে মনির সর্দার, ঠিক তখনই মান্নান মাওলানার বাড়ির ওদিক থেকে পুলিশের একটা জিপগাড়ি আইসা থামল সড়ক থেকে যে সরু হালট ঠাকুরবাড়ির দিকে আসছে সেই হালটের মুখে। ধামাধাম চার-পাঁচজন পুলিশ নামল গাড়ি থেকে। দেইখা নিয়ামতউল্লাহ ভয়ার্ত গলায় বলল, খাইছে আমারে, পুলিশ আইয়া পড়ছে।
বইলা কোনওদিকে আর তাকাইল না, ঠাকুরবাড়ির দিকে ঝাইড়া একটা দৌড় দিল। তার দৌড় দেইখা মনির সর্দার কয়েক পলক ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া রইল, তারপর সে দৌড় দিল মসজিদ বাড়ির ওইদিক দিয়া মেন্দাবাড়ির দিকে। মান্নান মাওলানা তাঁর নাদুস ভুড়িখানা নিয়া কোনদিকে দৌড় দিবেন ভাবছেন, পুলিশরা তার চারপাশে। লৌহজং থানার এএসআই ওয়াজিউল্লাহ হাসিমুখে মান্নান মাওলানাকে সালাম দিলেন। স্লামালায়কুম। আমি এএসআই ওয়াজিউল্লাহ। আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। বাড়িতে খুঁজতে গিয়েছিলাম, না পেয়ে এখানে এলাম। আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। আমার বাবা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তবে আপনাকে আমি হাতকড়া পরাব না। কোমরে দড়ি বাঁধব।
হাসিহাসি মুখটা তারপরই কঠিন হইয়া গেল ওয়াজিউল্লার। লগের কনেস্টবলদের দিকে তাকায়া বললেন, বাধ শালারে।
লগে লগে তিন-চারজন কনেস্টবল মোটা দড়ি দিয়া মান্নান মাওলানার মাজায় তিন চারটা প্যাঁচ দিয়া বানল।
ততক্ষণে গ্রামে খবর হইয়া গেছে পুলিশ আইসা মান্নান মাওলানারে ধরছে। এইবাড়ি ওইবাড়ি থেকে, চকমাঠ রাস্তা থেকে লোকজন, পোলাপান সব দৌড়াইয়া বাইর হইছে। নারী পুরুষ পোলাপান বুড়া, সবাই নাইমা আসছে বাড়ির ঘাটে। মসজিদ বাড়ি থেকে দুই-আড়াইকানি চকের মাঝখান দিয়া গেছে যে সরু হালট সেই হালটের দুই পাশের চকে নাইমা গেছে লোকজন। মতলারে দোকানে রাইখা বাদলা দৌড়াইয়া আসছে, আজিজ গাওয়ালের পোলাপান পরি নাদের হামেদ জরি, আবদুলের দুই পোলা আলালদ্দি বারেক আর মেয়েটা, মতলিবের তিন মাইয়া আরও কত পোলাপান। আজিজ গাওয়াল বানেছা, আবদুল আবদুলের বউ, তছি পাগলনি গভীর ঘুমে আছে সেই ফাঁকে বাইর হইছে তছির মা, রাবি বাইর হইছে, কুট্টি আলফু বাইর হইছে। কুট্টির পাশে দাঁড়ায়া আছে তার পোলা নয়ন।
ওয়াজিউল্লাহ একবার চারদিক তাকালেন। তারপর কনেস্টবলদের বললেন, চলো।
মাকুন্দা কাশেমকে যেভাবে কোমরে দড়ি বাঁধা হয়েছিল ঠিক সেই কায়দায় দড়ি বাঁধা মান্নান মাওলানাকে গোরুর মতন টাইনা নিতে লাগল কনেস্টবলরা।