ব্যভিচার অপরাধে অপরাধী একজন মহিলাকে খলিফা ওমর বিন খাত্তাবের দরবারে আনা হল। মহিলাকে খলিফা তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে স্বীকার করল যে ব্যভিচার করেছে। খলিফা তাকে পাথর মেরে হত্যার আদেশ দিলেন। হজরত আলী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, হয়তো মহিলাটির কোনও অপরাগতা ছিল যা তাকে ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হতে বাধ্য করেছে। মহিলাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে সে বলে, আমার একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে যখন পথ চলছিলাম তখন তার উটে পানি ও দুধ দুটোই ছিল, আমার উটে ছিল না। আমি চলতে চলতে পিপাসার্ত হই। পিপাসায় কাতর হয়ে যখন আমি আমার সঙ্গীর কাছে পানি চাইলাম সে তখন ব্যভিচারের প্রস্তাব দেয়। আমি অতি কষ্ট সহ্য করে তার প্রস্তাব তিনবার প্রত্যাখান করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিপাসায় যখন প্রাণ রক্ষা হচ্ছিল না তখন বাধ্য হয়ে প্রাণ বাঁচাতে তার প্রস্তাবে রাজি হই।
হযরত আলী সব শুনে বলে উঠলেন, আল্লাহ মহান। যে ব্যক্তি প্রয়োজনে অস্থির হয়ে কোনও নিষিদ্ধ কর্ম করে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিষিদ্ধ বস্তু গ্রহণ করে না এমন ব্যক্তির অপরাধ মার্জনীয়। নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। কারণ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। এই বর্ণনা ইমাম ইবনে কাইয়েম আল জাওজীয়া দিয়েছেন।
অতএব গ্রাম্য প্রধান ও গ্রামগঞ্জের ইমাম ও মোল্লাগণ শরিয়তি আইনের সঠিক ব্যাখ্যা করুন এবং সিদ্ধান্ত নিন, কারণ অপব্যাখ্যা ও মিথ্যা সিদ্ধান্তের দ্বারা কোনও নিরীহ ব্যক্তি বা সতী নারীর ওপর অপবাদ ও শাস্তি প্রদান করলে ভবিষ্যতে আল্লার ইচ্ছায় ওই শাস্তি আপনার এবং আপনার পরিবারের প্রতি বর্তাবে। কারণ আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠ বিচারক।
.
মাওলানা হোসারফ আলী সাহেবের কথাই সত্য হল।
‘বিক্রমপুর বার্তা’র ওইটুকু সংবাদ ধরে ঢাকার জাতীয় দৈনিকগুলো সাংবাদিকদের পাঠাতে লাগল মেদিনীমণ্ডল গ্রামে। এখন ঢাকা থেকে মাওয়া-মেদিনীমণ্ডল আসতে একঘণ্টা সময়ও লাগে না। মিনিট চল্লিশেকের মধ্যেই গুলিস্থান থেকে মাওয়া চলে আসা যায়। কোনও কোনও বাসকে অনুরোধ করলে মেদিনীমণ্ডলেও নামায়া দেয়। নূরজাহানের ঘটনা নিয়া তিন-চারদিনের মধ্যে গরম হইয়া গেল মেদিনীমণ্ডল। সাংবাদিকরা গ্রামের অনেকের লগে কথা বললেন। কেউ কেউ সত্য কথা বলল, কেউ কেউ মান্নান মাওলানা আতাহার মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহর ভয়ে মুখ খুলল না। দবির দৌড়াদৌড়ি করছিল থানায়। হামিদা সারাদিন ঘরে বইসা, উঠানে বইসা বিলাপ কইরা কান্দে। নূরজাহানরে, আমার নূরজাহান।
সাংবাদিকরা অনেকেই তার লগে কথা কইছে। দবিরের লগেও কইছে কেউ কেউ। মতি মাস্টার, মুকসেদ আজিজ গাওয়াল আবদুল আলফু এমনকী বাদলা তরি সাহস কইরা সত্য ঘটনা বইলা দিছে সাংবাদিকদের। মতলিবের বাড়িতে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা। মতলিব আর মতলিবের ছোট ছোট ওই তিনটা মেয়েই তাদের মতন কইরা যা যা দেখছে বলছে। নূরজাহানরে তারা আর ছোটমা বলত না, বলত লক্ষ্মীমা, লক্ষ্মীমার জন্য তিন মেয়েই কাঁদল। আর রাগ কান্না ক্রোধে ফাইটা পড়ল করিমন্নেসা ওরফে কিরনী। তুমুল বকাবাজি মান্নান মাওলানাকে সে করল। বলল, ওই শুয়োরের পোরে যেমতে পারেন জেলে ঢুকান, ফাঁসি দেন কুত্তার বাচ্চারে। ও ভণ্ড মলবি। আমগো লক্ষ্মীরে মাইরা ফালাইছে।
দবির তার এজাহারে আসামি করেছিল চারজনকে। মান্নান মাওলানা, আতাহার, মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ। এইসব নিয়া দেশের জাতীয় বাংলা ইংরাজি দৈনিক পত্রিকাগুলি সমানে রিপোর্ট ছাপাতে লাগল।
মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ একদিন আসল মেদিনীমণ্ডল গ্রামে। প্রথমেই দবির গাছির বাড়িতে গেলেন তারা। নূরজাহানের কবরে ফুল দিয়া শ্রদ্ধা জানান তার বিদেহী। আত্মাকে। মহিলা পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট মালেকা বেগমের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির আন্দোলন বিভাগের সম্পাদিকা বেবী মওদুদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খালেদা মাহবুব, তারা দবির গাছি হামিদা আর মতলিবের লগে কথা বলেন, সমবেদনা জানালেন আর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করলেন প্রশাসনের কাছে।
তিনদিন পর সকালবেলা ঘটল ঘটনা।
ফজরের নামাজ পড়ে আজ আর বাড়িতে যান নাই মান্নান মাওলানা। মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লারে নিয়া বইসা ছিলেন ইমাম সাহেবের ঘরে। মুখে গভীর দুশ্চিন্তা। দেলোয়ারার চোখের ছানি কাটাইয়া, তার চক্ষু ভাল কইরা তারে নিয়া বাড়িতে আসছে মোতালেব। এনামুলও আসতে চাইছিল, কন্ট্রাকটরির বড় একটা কাজ চলছে বইলা আসতে পারে নাই। তবে নূরজাহানের ঘটনা শুইনা বিরাট চেতা চেতছে সে। মোতালেবরে পরিষ্কার বইলা দিছে, আপনে বাড়িতে গিয়াঐ ওই ভণ্ড মাওলানারে হোগায় লাখি দিয়া খেদাইবেন। বেশি বেতন দিয়া, শিক্ষিত ভদ্র, আসল ইমাম জোগাড় করবেন মসজিদের লেইগা। আমগো মসজিদে য্যান ওই শালারে আমি আর না দেহি।
চেতছেন দেলোয়ারাও। তিনি মুখ খারাপ করার মতন মানুষ না। বলছেন, এনামুল আর আমি এতকিছু করার পরও ছেমড়িডারে সে বাঁচতে দিল না! এমুন অপমান কইরা মারলো অরে। মোতালেব, ওই ভণ্ড য্যান আমগো বাড়িতে আর না আইতে পারে, এনামুল যেমতে বলছে অমতে অমতে তুই নতুন ইমাম ঠিক কর। অরে খেদা।