মতি মাস্টারের মুখের দিকে তাকায়া মুকসেদ বলল, ওইটা কী বললেন মাস্টার সাব?
কোনটা?
ওই যে পাথর মারার শাস্তি…
ও, শব্দটা হইতাছে ‘সঙ্গেসার’। এইটা ইহুদিদের বহু বহু বছরের পুরানা একটা পদ্ধতি। দুইটা শব্দ আছে ‘রজম’ আর ‘সঙ্গেসার। অর্থ হইল পাথর মারা।
.
মাওলানা তোসারফ আলী সাহেব স্কুলঘরটার ওইদিককার আমগাছতলায় পায়চারি করছেন। তাঁর হাতে তসবি, পরনে গুড়মুড়া তরি লম্বা সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। মাঘমাসের রোদ গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়া আইসা পড়ছে স্কুলঘরের চালে, সামনের সবুজ মাঠটুকুতে। তিনি সেই মাঠে পায়চারি করছেন।
মতি মাস্টার আর মুকসেদ আইসা একলগে তাকে সালাম দিল। আসসেলামেলায়কুম।
তিনি চোখ তুইলা তাদের দিকে তাকালেন। ওয়ালাইকুমআসোলাম। কেমন আছেন আপনারা?
মতি মাস্টার বললেন, তেমুন ভাল নাই হুজুর। মনটা খারাপ। এইজন্য আপনের কাছে আসলাম। যুদি সময় থাকে তাইলে একটু কথাবার্তা বলবো।
চলুন ঘরে গিয়ে বসি।
মুকসেদ বলল, এইখানেই বসন যায়। আমি ইস্কুল ঘর থিকা চেয়ার বেঞ্চি লইয়াসি।
আপনেরা চেরে বইলেন, আমি বেঞ্চে বহুম নে।
মুকসেদ আর কারও অনুমতি নিল না। স্কুল ঘরে ঢুইকা দুইখান চেয়ার আর একখান বেঞ্চি নিয়া আসল। আমগাছতলায় চেয়ার দুইটা রাখল মুখামুখি, বেঞ্চিটা রাখল একটু দূরে। বহেন হুজুর, বহেন। মাস্টার সাব, আপনেও বহেন।
তাঁরা বসার পর মুকসেদ নিজে বসল বেঞ্চে, তবে খুবই বিনয়ী, জড়সড় ভাব।
চেয়ারে বইসাই ইমাম সাহেব বললেন, মাস্টার সাহেব, এটা কেমন কাজ হল আপনাদের পাড়ায়? ধর্মের নামে একজন ভণ্ড মাওলানা এমন একটা কাজ করল, একটা মেয়েকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল আর আপনারা কেউ কিছু বললেন না? ঘটনাটা সবাই মেনে নিলেন?
মতি মাস্টার মাথা নিচা কইরা বলল, আমার অবস্থা তো আপনে জানেনই হুজুর! ক্ষমতা বইলা কিছু নাই। মান্নান মাওলানা আর তার ছেলে, লগে আরও দুইটা নতুন পয়সাআলা মুসল্লি হইছে, দুইটাই টাউট।
বুঝেছি বুঝেছি। মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ।
জি। তাগো লগে অনেক মানুষ। টাকাপয়সা দিয়া তারা অনেক কিছু করে।
তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে এই লোকের বড় রকমের শাস্তি হওয়া উচিত। আমি আপেল মেম্বার সাহেবরে বলেছি। তিনি জানাবেন ঢাকায় থাকা তার ভাই আর চাচাঁদেরকে। খানসাহেবরা বোধহয় এই ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেবেন। মান্নান মাওলানাকে তাঁরা বোধহয় এবার একটু দেখে নেবেন।
শুইনা মতি মাস্টার আর মুকসেদ দুইজনের মুখই উজ্জ্বল হল। মতি মাস্টার বললেন, ওইটা হইলে একটা কাজের কাজ হইব! নাইলে ভণ্ডটা আরও আশকারা পাইয়া যাইবো।
মাওলানা তোসারফ আলী সাহেব একবার আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, শুনলাম মুনশিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা, নাম বোধহয় বিক্রমপুর বার্তা সেই পত্রিকায় ছোট আকারে নূরজাহানের ঘটনা ছাপা হয়েছে। তাতে প্রশাসন নিশ্চয় নড়েচড়ে উঠবে। হয়তো বা ঢাকার বড় বড় দৈনিক পত্রিকাগুলো ব্যাপারটাকে আমলে নেবে। এইরকম মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনা, ভুল মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে একটি মেয়েকে হত্যা করবে, এটাকে তো আমি হত্যাই বলব, এই ঘটনা সারাদেশের বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেবে। খবরের কাগজ হচ্ছে সমাজের দর্পণ, আমি নিশ্চিত, এই ঘটনা অনেক বড় হয়ে দাঁড়াবে। ওই ভণ্ড মাওলানা এবার আর পার পাবে না। এদিকে এই বাড়ির খান সাহেবরাও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছেন, সুতরাং অবস্থা কোন দিকে যায় দেখেন।
একটু থামলেন তিনি, তারপর বললেন, শুনুন, আমি কেন, এটা গ্রামের প্রত্যেকেই আপনারা বুঝেছেন মান্নান মাওলানা মেয়েটির ওপর প্রতিশোধ নিলেন। পুরনো ঘটনাগুলো আমি বলতে চাই না, আপনাদের গ্রামে আসার পরই শুনেছি। কেন মেয়েটি তার মুখে থুতু দিয়েছিল সেটা সবাই বোঝে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এক পর্যায়ে মেয়েটিকে তিনি বিবাহ করতেও চেয়েছেন। না পেরে শেষ পর্যন্ত এইভাবে প্রতিশোধটা নিলেন। তালাকনামা নকল ছিল না। তিনি গায়ের জোরে নকল বলে কাজটা করলেন। যদি তালাকনামা নকলও হত তাও তিনি পবিত্র কোরান মজিদের নামে মিথ্যা বলে এই ফতোয়া দিতে পারেন না। মাস্টার সাহেব আমি শুনেছি আপনি প্রতিবাদ করেছিলেন, কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।
জি। মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শাফী দেওবন্দী রচিত ‘আল-হীলাতুন-নাজিয়া’ থেকে। ওই কিতাবে পরিষ্কার লেখা আছে, যে স্ত্রীর স্বামী লাপাত্তা নিরুদ্দেশ, সেই স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে।
একদম ঠিক কথা। মেয়েটির স্বামী চলে গেছে বহু আগে। এই অবস্থায় আপনা আপনিই তালাক হয়ে যায়। সুতরাং মেয়েটির বিয়ে কিছুতেই অবৈধ নয়। সে কোনও জিনা বা ব্যভিচার করেনি। তা ছাড়া ব্যভিচারের জন্য পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা কোরআনে নেই। তবে এ ব্যাপারে অনেকে দু-একটি হাদিস উল্লেখ করেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, মহানবীর (সাঃ) হাদিস তাঁর যুগের বহু পরে সংগৃহীত হয়েছে আর এ কারণেই এসব হাদিসের মধ্যে ছহি, জইফ বা সত্য মিথ্যা বাছাইয়ের প্রশ্ন সংগ্রহের প্রাথমিক যুগ থেকেই রয়েছে। পাথর মেরে হত্যার বিধান ইহুদি শাস্ত্রের নীতি, তৌরাতের দ্বিতীয় বিবরণে ২২:২২ পদে উল্লেখ আছে। ব্যভিচারের শাস্তির জন্য ইসলামি বিধান নাজেল হওয়ার পূর্বে হয়তো আরব দেশে পূর্ববর্তী শরিয়তের বিধান মতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওটা আমল করা। হয়েছিল। তবে কোরানে ব্যভিচার সম্বন্ধে ইসলামি বিধান নাজেল হওয়ার পর তা রহিত করা হয়। ইসলামি শরিয়ত ব্যবস্থা পরিপূর্ণরূপে নাজেল হওয়ার পূর্বে হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) পূর্ববর্তী শরিয়ত ব্যবস্থারই অনুসরণ করতেন, যেমন রোজার বিধান নাজেল হওয়ার আগে মহরম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখা, কিংবা বায়তুল মোকাদ্দসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করা। এসব নিয়ম ইসলামি বিধান নাজেলের পর রহিত হয়। সেরূপ ব্যভিচারের স্পষ্ট শাস্তির বিধান নাজেল হওয়ার পর পূর্ববর্তী ইহুদি পদ্ধতি রজম বা সঙ্গেসার বা পাথর মারা রহিত হয়। অতএব পবিত্র কোরআনের সুরা নূরের প্রথম কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর জিনাকারীর জন্য মিয়া জালদাতীন বা একশো দোররা এবং সতী নারীর ওপর অপবাদকারীকে আশিটি দোররা দেওয়ার হুকুমের পর ইহুদি বিধানের স্থান নেই।