মতি মাস্টারের মুখটা দুঃখী, বিষণ্ণ। মুকসেদের কথা শুইনা বললেন, যাই ইকটু খাইগোবাড়ি মিহি।
ওইমিহি গিয়া কী করবেন। অহনতরি তো ইস্কুল খোলে নাই। পরীক্ষাপুরিক্ষা হইয়া গেছে, স্কুল খুলবো আরও দশ-পোনরো দিন পর।
না না স্কুলের কামে যাইতাছি না। যাইতাছি খাইগোবাড়ির মসজিদের মাওলানা হুজুরের কাছে। উনি তো পয়লা পয়লা কেঐর লগে তেমুন মিলামিশা করতেন না, আইজকাইল করেন। আমার লগে ভাল খাতির। যাই তার লগে গিয়া ইকটু কথাবার্তা কইলে মনডা ভাল লাগবো। কেমুন কারবারডা হইয়া গেল গেরামে?
হ মাইয়াডারে শেষতরি বাঁচতে দিল না।
তারপর থিকা আমার মনডা বহুত খারাপ। মান্নান মাওলানা যে কোরান হাদিসের নামে, আল্লাহর নামে মিথ্যা, ভুল আর বানোয়াট ফতোয়া দিতাছিল সেইটা আমি বুজছি। ওই জন্যই কথা বলতে চাইছিলাম।
না বইলা ভাল করছেন, চইলা আইসা ভাল করছেন।
হ ওই দৃশ্য আমি সইজ্য করতে পারতাম না। আমি মাস্টার মানুষ, লেখাপড়া জানা মানুষ। ইসলাম ধর্ম সমন্ধে আমি অনেক বই পড়ছি দাদা। আমি মনে করি মান্নান মাওলানা সাবের থিকা আমি অনেক বেশি জানি।
সেইটা অবশ্যই আপনে জানেন। তয় ওহেনে থাকলে আর আপনে যদি কথাবার্তা কইতেন, অরা তো মানুষ ভাল না, আপনেরে অপমান করতো।
সেইটা বুইঝাই আমি চুপ কইরা উইঠা চইলা আসলাম।
তারপরই যেন মতি মাস্টার খেয়াল করলেন, মুকসেদ তার লগে লগে হাঁটছে। তিনি অবাক হইলেন। আপনে কই চললেন?
মুকসেদ হাসল। যাই আপনের লগে।
কই?
খাইগোবাড়ির হুজুরের কাছে। তার কথাবার্তা, আপনের কথাবার্তা শুনি।
আইচ্ছা চলেন।
চকপাথালে হাঁটতে হাঁটতে মতি মাস্টার বললেন, আপনেরে অন্য রকমের কিছু কথা বলি দাদা। নূরজাহান মেয়েটার খবর আমি লইছি। তার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময়। উনিশ শো একাত্তর সালে। তারে যেদিন ঢিলাইয়া আত্মহত্যা করতে বাধ্য করলেন মান্নান মাওলানা সেদিন আছিল দশই জানুয়ারি। দশই জানুয়ারি একটা ঐতিহাসিক দিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, উনিশ শো বাহাত্তর সালের দশই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হইয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরা আসছিলেন। তার ফিরা আসার দিন এই স্বাধীন বাংলাদেশে একজন স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে ভুল ফতোয়া দিয়া একটা নিরীহ মেয়েরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল।
মুকসেদ চমকাইল। আরে এইডা তো একটা বিরাট দামি কথা কইছেন মাস্টার সাব। আমি তো এইভাবে ভাইবা দেখি নাই।
আরেকটা কথাও আপনেরে বলি দাদা। নূরজাহানের পরনের শাড়িটা আপনে খেয়াল করছিলেন?
করছি। কউজ্জা (সবুজ) রঙ্গের শাড়ি, পাইড়টা আছিল লাল রঙ্গের।
তার মানে কী? নূরজাহানের শাড়ির রং আছিল বাংলাদেশের পতাকার রং।
মুকসেদ আবার অবাক। তাই তো! নূরজাহানের শাড়ির রং তো আছিল বাংলাদেশের পতাকার রঙের। এই পতাকার লেইগা একাত্তর সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি। তিরিশ লাখ লোক আমগো মারা গেছে। আড়াইলাখ মা বইনের ইজ্জত নষ্ট হইছে। এক কুট্টি লোক উদবাস্তু হইয়া চইলা গেছিল ইন্ডিয়ায়।
আর এই স্বাধীন বাংলাদেশে একজন স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে, বাংলাদেশের পতাকা রঙের শাড়ি পরা নিরীহ একটা মেয়েরে এত মানুষজনের সামনে যেইভাবে অপমান করল, তারে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল, এইটা কোনও দেশপ্রেমিক মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব, বলেন?
কথা ঠিক।
আর রব্বান যে নূরজাহানরে তালাক দিছে, তালাকনামা যে ভুয়া বা নকল না, এইটা কিন্তু আমি বুজছি। এই জন্য তালাকনামাটা দেখতে চাইছিলাম।
আমি সেইটা বুজছি মাস্টার সাব।
আমি গরিব স্কুল মাস্টার, থাকি মান্নান মাওলানার বাড়ির অন্য অংশে। টাকার শক্তি নাই, গায়ের শক্তি নাই, লোকবলও নাই। থাকলে আমি এই ঘটনার প্রতিবাদ করতাম।
তয় আমি মনে করি খান সাবরা মান্নান মাওলানারে এইবার দেইখা লইবো। তারা এই পাড়ার দিকে তেমন মনোযোগ দেয় নাই, তয় তাগো বাড়ির পোলারা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা। তারা এইবার ওই শালার একটা বিহিত করবো।
আমি মাওলানা তোসারফ আলী সাহেবের লগে এইসব লইয়াই কথা কমু। গায়ের জোরে না পারি, বুদ্ধির জোরে আমি কিছু একটা করতে চাই।
আমি আছি আপনের লগে। লন যাই।
খাইগোবাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মতি মাস্টার বললেন, আপনেরে একখান ঘটনা বলি দাদা। হজরত ঈসা আলাইহেওয়াসাল্লাম নারী সমাজের সাথে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করতেন। একবার হজরত ঈসা আলাইহেওয়াসাল্লামের শিষ্যরা এক মহিলাকে তাঁর সামনে নিয়া আসলেন। মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে ব্যভিচার করেছে। হজরত ঈসা আলাইহেওয়াসাল্লাম মহিলার সাথে সদয় ব্যবহার করলেন। তাতে হযরত ঈসা আলাইহেওয়াসাল্লামের শিষ্যরা খুবই দুঃখিত হলেন, খুবই অবাক হলেন। বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগলেন শিষ্যরা। তাদের এই ভূমিকা দেখে হজরত ঈসা আলাইহেওয়াসাল্লাম বেশ ক্ষুব্ধ হলেন, মানে রেগে গেলেন। বললেন, ঠিক আছে, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ পাপ না করে থাকে তা হলে সে এই মহিলাকে ‘সঙ্গেসার’ বা পাথর মারার শাস্তি প্রদান করতে পারো।’ হজরত ঈসা আলাইহেওয়াসাল্লামের এই বাণী থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, সেই কালে ব্যভিচারের পাপমুক্ত পুরুষের সংখ্যা খুবই কম ছিল।