ততক্ষণে নূরজাহানের মুখ আর মুখ নাই। তার মুখ হইয়া গেছে মার খাওয়ার পর মাকুন্দা কাশেমের মুখ যেমন হইয়া গেছিল, ঠিক তেমন। ইটের টুকরার আঘাতে আঘাতে তার ঠোঁট ছিন্নভিন্ন, গাল নাক ছিন্নভিন্ন, কপাল ফাইটা থেঁতলাইয়া বীভৎস।
একশো একটার আর বোধহয় কয়েকটা বাকি আছে, নূরজাহান লাফ দিয়া উঠল গর্ত থেকে। কোনওদিকে তাকাল না, প্রাণপণে একটা দৌড় দিল নিজেদের বাড়ির দিকে। ভাদাইম্মা কুকুরটাও দৌড় দিল তার পিছন পিছন। সবাই তাকায়া রইল সেইদিকে।
মান্নান মাওলানা বললেন, অরে দেইখা আর লাব নাই। পঞ্চায়েতের ভাইরা, হাজেরানে মজলিশ, আসেন অন্যদের শাস্তি কার্যকর করি।
.
নূরজাহান তখন আর নূরজাহানের মধ্যে নাই।
বাড়িতে আইসা সে ঢুকল ছোট্ট সেই ঘরে। রব্বানের লগে যেই ঘরে তার সুখের দিনগুলি কাটছিল। এই ঘর এখনও তালা দেওয়া থাকে। আজও আছে। চাবি কোথায় কে নজানে। নূরজাহান কোনও কিছু খেয়াল করে না, দুই হাতে এত জোরে দুই-তিনটা ধাক্কা দেয় দরজায়, হাট কইরা খুইলা যায় দরজা। ঘরে ঢুইকা আলমারির উপরে রাখা এলড্রিনের শিশিটা নেয়। ইরি খেতের মাজরা পোকা মারার জন্য কিনা রাখছিল দবির। প্রে মেশিনও একটা ভাড়া কইরা আইনা রাখছে। নূরজাহান কোনও কিছু ভাবল না, কোনওদিকে তাকাল না, শিশি খুইলা পুরা শিশি উপুড় কইরা ঢাইলা দিল মুখে। গলা দিয়া সেই জিনিস নামতে লাগল নীচের দিকে। নূরজাহানের মনে হলো কামারবাড়ির লোকেরা লোহা গলাইয়া লাল, নরম থকথকা কইরা ফালাইলে সেই জিনিস গিলতে যেমন লাগব, কীটনাশক ঠিক তেমন কইরা নামতাছে তার গলা দিয়া। সে যখন গর্ত থেকে উঠছিল, তখন মনির সর্দার বলছিল, এই মুখ তুই আর কেঐরে দেহাইচ না ছেমড়ি। এই মুখ মাইনষেরে দেহানের থিকা মইরা যাওন ভাল।
টলতে টলতে ঘর থিকা বাইর হইল নূরজাহান। উঠানে আছাড় খাইয়া পড়ল। নূরজাহানদের উঠানে তখন মাঝিবাড়ির বউঝিরা, পোলাপানরা আর ভাদাইম্মা কুকুরটা। নূরজাহানকে উঠানের মাটিতে পইড়া থাকতে দেইখা কুকুরটা পাগলের মতন তার চারপাশে চক্কর খাইতে লাগল আর খেউক্কাইতে লাগল।
নূরজাহানের মুখ দিয়া তখন ছেবড়ি পড়ছে।
মসজিদ বাড়িতে বিচার সালিশ তখন শেষ পর্যায়ে। মুখে আঁচল চাইপা দবিররে বেত দিয়া বাইড়াইতাছে হামিদা, মাঝিবাড়ির পোলা ময়নাল দৌড়াইয়া আইসা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলল, নূরজানবুজি পুরা একশিশি এনডিরিন খাইয়া হালাইছে। উডানে পইড়া রইছে। এতক্ষুনে মনে অয় মইরা গেছে।
হাতের বেত ফালাইয়া হামিদা দৌড় দিল বাড়ির দিকে আর দবির জান পরান দিয়া দৌড় দিল সড়কের দিকে। সড়কে উইঠা লৌহজংয়ের দিকে দৌড়াইতে লাগল সে।
মান্নান মাওলানা কোনও কিছুর তোয়াক্কা না কইরা বললেন, পঞ্চায়েতের ভাইয়েরা, হাজেরানে মজলিশ, আমি কোরান হাদিসের মতে, শরিয়ত মতে বিচার কাজ শেষ করছি। এখন আসেন আল্লাহপাকের দরবারে মোনাজাত করি। হাত উঠান, বেবাকতে হাত উঠান।
মান্নান মাওলানা মোনাজাত ধরলেন।
সেই দিনই লৌহজং থানায় এজাহার করেছিল দবির। মামলার তদন্তে আসল এএসআই ওয়াজিউল্লাহ। গ্রামের অনেকের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হলো। ততক্ষণে বিকাল হইয়া গেছে। নূরজাহানের লাশ পইড়া আছে উঠানে। টেম্পোতে কইরা সেই লাশ পাঠানো হইল মুনশিগঞ্জ সদরে পোস্টমর্টেমের জন্য। লৌহজং থানার ওসি, ইউসুফ চৌধুরী প্রথমে বলেছিলেন, এটা নিছক আত্মহত্যা। পরে অবশ্য তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। দুইদিন পর মুনশিগঞ্জ সদর থেকে ওই একই কায়দায়, টেম্পোতে কইরা নূরজাহানের লাশ আনা হয় গ্রামে। মান্নান মাওলানা ফতোয়া দিলেন, এই মাইয়া জেনা করছে, অর দাফন হইবো না। কবরে বেড়া দেওয়া যাইবো না।
এবার আর মান্নান মাওলানার কথা কেউ শুনল না। আমিন মুনশি সাহেব আজ সকালেই গ্রামে ফিরেছেন, ঘটনা শুইনা বললেন, মন্নাইন্না হইল ইবলিস শয়তান। ও কোরান হাদিসের দোহাই দিয়া, কোরান হাদিস আর আল্লার নামে মিছাকথা কইয়া মাইয়াটারে মারছে। আমি অর জানাজা পড়ামু। আমার পোলা আবদুস সালাম নামকরা উকিল। তারে দিয়া মন্নাইন্নার নামে কেস করামু।
দবিরের বাড়ির বাশঝাড়তলায় নূরজাহানকে কবর দেওয়া হল। বাদলা আলফু মতলিব মাঝিবাড়ির লোকজন সবাই মিলা কবর দেওয়ার পর বাঁশ কাইট্টা চটি বানাইয়া একখান বেড়াও দিল নূরজাহানের কবরে। দবির হামিদা উঠানের মাটিতে বইসা বইসা সব দেখল। তাদের চোখে পানি নাই, মুখে কথা নাই। তারা য্যান আর মানুষ নাই, তারা য্যান মাটি হইয়া গেছে, গাছপালা পাথর হইয়া গেছে।
কাঁচা কবর দেইখা কয়েকটা শিয়াল আইসা ঘুরঘুর শুরু করছিল সন্ধ্যার পর থেকেই। মানুষের লাশ খাইতে শিয়ালেরা খুব পছন্দ করে। ভাদাইম্মা সারারাত বইসা রইল নূরজাহানের কবরের সামনে। শিয়ালের আওয়াজ পাইলেই এমুন খেউক্কানি শুরু করে, এমুন কইরা দৌড়ানি দেয় শিয়ালগুলিরে, নূরজাহানের কবরের কাছে তারা আগাইতেই পারল না।
.
কই যান মাস্টারসাব?
মতি মাস্টার মাত্র বাড়ি থেকে নামছেন, মুকসেদ উঠছিল তাঁর বাড়ির দিকে। দুইজনে মুখামুখি দেখা। মাঘ মাস বলে মতি মাস্টারের হাতে ছাতি নাই। পরনে পাজামা পাঞ্জাবির ওপর খদ্দরের চাদর। পায়ে মোজা আর পুরানা পামশু। মুকসেদের পরনে লুঙ্গি পাঞ্জাবির ওপর পুরানা ঘিয়া রঙের শাল। পায়ে কিছু নাই। মাথায় টুপি আছে।