এই প্রথম এনায়েত তাকাল মান্নান মাওলানার দিকে। এই শাস্তির পর কী হইব হুজুর?
কী আর হইব? মতলিবের লগে নূরজাহানির বিয়া বাতিল হইয়া যাইবো।
শুইনা হাহাকার কইরা উঠল মতলিব। না না হুজুর, শাস্তি যা দেওনের দেন, বিয়াডা বাতিল কইরেন না। লক্ষ্মী আমার সংসারডারে বাঁচাইয়া দিছে, আমার আগের বউ আর মাইয়া তিনডারে বাঁচাইয়া রাখছে লক্ষ্মী।
মান্নান মাওলানা ভুরু কুঁচকায়া বললেন, লক্ষ্মী?
আমার আগের বউ অর নাম দিছে লক্ষ্মী।
হিন্দুনাম। মালাউন নাম। এই নামের লেইগা তগো শাস্তি আরও বেশি হওন উচিত।
আকবর বলল, আমি একহান কথা কইতে চাই হুজুর।
কও, কও।
আপনে বলছেন হুজুর কোরান মজিদে জেনাকারীর এই শাস্তির বিধান আছে। তয় আপনে ওইডাঐ করবেন। আমার কথা হইল আপনে চাইলে তো বুক তরি গদে না খাড়া। করাইয়া আড়ু (হাঁটু) তরি করাইলেও পারেন। পাথর একশো একটাই ফিকলেন! আর গাছি গেরামের পুরানা মানুষ, ছোডকাল থিকা তার হাতের রস খাই আমরা, তার আর তার বউর শাস্তিডা ইকটু কমাইয়া দিলেন। সাক্ষী সাবুদগো শাস্তি কমাইয়া দিলেন। আপনে ইচ্ছা করলে তো পারেনঐ।
মান্নান মাওলানা আকবরের দিকে তাকালেন। হ সেইটা আমি পারি। বিচারকের হাতে অনেক কিছুর ভার দিছেন আল্লায়। বিচারক ইচ্ছা করলে শাস্তি কমবেশি করতে পারে। আমি তোমার কথা মাইনা নিলাম। বিয়াতে যারা সাক্ষীসাবুদ আছিল তাগো আমি দশবার কইরা কান ধইরা ওঠবস করামু, দউবরা আর দউবরার বউরে আশিটার জাগায় পঞ্চাশটা কইরা দোররা মারুম। দোররা জিনিসটা হইল চামড়ার চাবুক। সেইটা আমগো কাছে নাই। আমরা মারুম পঞ্চাশটা কইরা বেত। পয়লা দউবরা দউবরার বউরে মারবো পঞ্চাশটা বেতের বাড়ি, তারবাদে দউবরার বউ দউবরারে মারবো পঞ্চাশটা বেতের বাড়ি। তয় নূরজাহানি আর মতলিবের কোনও ক্ষমা নাই। একশো একহান পাথর অগো আমি নিজ হাতে মারুম। অরা গদে খাড়ইয়া থাকবো, আমি পাথর মারুম। তয় আকবরের কথা আমি রাখলাম। বুক তরি না, আডু তরি গদে অগো আমি খাড়া করামু। বোরহান, আড়ু তরি গদ কর।
সুরুজের দিকে তাকালেন মান্নান মাওলানা। সুরুজ, আমার ঘরে চকির উপরে দেখ দুইখান বেত আছে, লইয়া আয়।
সুরুজ দৌড়াইয়া গিয়া বেত নিয়া আসল।
ততক্ষণে আমগাছতলায় বড় একখান গর্ত কইরা ফালাইছে বোরহানউদ্দিন। রাবি কুট্টির লগে চেনা অচেনা অনেক মহিলা দল বাইন্ধা দাঁড়ায়া আছে একদিকে। তাদের দিকে তাকাইয়া মান্নান মাওলানা দুইজনকে বললেন, সায়রা আর মাসুদা, তরা দুইজনে ধইরা গদে নামা নূরজাহানিরে। অর শাস্তি বেবাকতের আগে।
যাইতাছি হুজুর।
দুইজন লগে লগে পা বাড়াইল। এরা বোধহয় চউরানি। মোটাতাজা বাজখাই ধরনের মহিলা। অনেকেই এদেরকে চিনল না। তারা দুইজন গিয়া নূরজাহানের দুই হাত ধরল। নূরজাহানের মুখ থেকে, মাথা থেকে ঘোমটা খইসা পড়ল।
দবির অসহায় চোখে তাকায়া আছে মেয়ের দিকে। হামিদা অন্যদিকে মুখ ফিরায়া ফোঁস ফোঁস কইরা কাঁদছে।
মান্নান মাওলানা বললেন, আমরা তো পাথর জোগাড় করতে পারি নাই। মজজিদ বানানের খোয়া সুরকি দিয়াঐ কাম চালামু।
নূরজাহানের চোখে মুখে তখন দিশাহারা ভাব। তাকে যখন টাইনা হেঁচড়াইয়া গর্তের দিকে নিয়া যাওয়া হইতাছে, সে অসহায় চোখে দবিরের দিকে তাকাল। আমি ইকটু বাবার লগে কথা কমু। ইকটু কথা কমু বাবার লগে।
মান্নান মাওলানা হুংকার দিলেন। তর বাপের আমি খেতাপুড়ি। ওই, গদে নামা অরে। তাড়াতাড়ি নামা।
মতি মাস্টার একটা দীর্ঘশ্বাস ফালাইয়া নিঃশব্দে উইঠা দাঁড়ালেন। আস্তে করে মুকসেদকে বললেন, লন দাদা, যাই গা।
লন।
তারা দুইজন চুপচাপ ভিড়ের ভিতর থেকে বাইর হইয়া চকের দিকে নাইমা গেলেন।
চেয়ারের পাশে রাখা গোড়া থেকে এক খাবলা ইটের টুকরা তুললেন মান্নান মাওলানা। বড়সড় একটা টুকরা শরীরের যাবতীয় শক্তি দিয়া ছুঁইড়া মারলেন নূরজাহানের মুখ বরাবর। ধারালো ইটের টুকরা গিয়া দুই ঠোঁটের মাঝখানে এমন জায়গায় লাগল, নূরজাহানের ছিটায়া দেওয়া ছ্যাপ মান্নান মাওলানার ঠোঁটের যেখানটায় লাগছিল।
তারপর উত্তেজনায় দাঁড়ায়া গেলেন মান্নান মাওলানা। হাতের সমস্ত শক্তি দিয়া, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়া দাঁতে দাঁত চাইপা একটার পর একটা ইটের টুকরা ফিকতে (ছোড়া) লাগলেন নূরজাহানের মুখ বরাবর। নূরজাহানদের বাড়ি থেকে ভাদাইম্মা কুকুরটা কোন ফাঁকে আইসা পড়ছে এখানে, ভিড়ের মধ্যে কেউ সেইটা খেয়াল করে নাই। নূরজাহানকে এইভাবে ইটা মারছে দাড়িটুপিআলা একজন লোক, দেইখা আচমকা খেউক্কাইতে লাগল সে, রাগে ক্রোধে দাঁত মুখ খিচাইয়া গরগর করতে লাগল। কোদাল হাতে বোরহানউদ্দিন তাড়া কইরা গেল ভাদাইম্মারে। তাড়া খাইয়া রাস্তার দিকে দৌড়াইয়া গেল সে, বোরহানউদ্দিন একটু আড়াল হইছে দেইখা আবার ফিরা আসল, আবার খেউক্কাইতে লাগল। কুট্টির পোলা নয়ন মায়ের কোল থেকে নূরজাহানের দিকে তাকায়া ছিল। কুট্টি একহাত দিয়া পোলার চক্ষু বন্ধ কইরা দিল। তাড়াতাড়ি হাঁইটা বাড়ির দিকে চইলা গেল। এই দৃশ্য পোলারে দেখতে দিব না।
নূরজাহান তখন আল্লাগো আল্লাহ, আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ, বলে চিৎকার করছে। মান্নান মাওলানা একটা কইরা ইটের টুকরা ছোড়েন আর নূরজাহান আল্লাহ বইলা একটা চিৎকার দেয়। মিনারে বসা মোতালেবের পালা একটা সাদা কবুতর স্তব্ধ হয়ে আছে। ওড়ার ক্ষমতা যেন হারায়া ফেলছে কবুতরটি। মাঘমাসেও পদ্মার দিক থেকে আসে নরম একটু হাওয়া। সেই হাওয়া বন্ধ করেছে তার চলাচল। গাছের পাতারা নিথর হয়ে আছে, চকেমাঠে আর গিরস্তবাড়ির উঠান পালানে পড়া রোদ যেন রোদ না, রোদ যেন আসলে গভীর এক অন্ধকার। দিনেরবেলাই যেন নেমে গেছে অন্ধকার রাত। মাথার ওপর আছে যে নীলসাদায় আশমানখানি, ওরকম সাতখান আসমানের উপরে আছে মহান আল্লাহপাকের আরশ, মান্নান মাওলানা একটা কইরা ইটের টুকরা ছোড়ে, নূরজাহান আল্লাগো আল্লাহ বলে চিৎকার করে, তার সেই চিৎকার সাত আশমান ভেদ করে চলে যায় আল্লাহপাকের আরশের কাছে। আল্লাহর আরশ কাঁইপা কাইপা ওঠে।