হামিদা বলল, আমার মাইয়ার স্বভাব খারাপ না। জামাই পলাইছে অন্য কারণে।
খামোশ। আমার পারমিশন ছাড়া কথা কবি না।
হামিদা থতমত খাইয়া থাইমা গেল।
মান্নান মাওলানা বললেন, তয় বচ্ছর দুয়েকবাদে মতলিবের লগে নিকা অইলো নূরজাহানির। আসল ঘটনা ঘটল এইখানে। আগের স্বামীর কাছ থিকা তালাক না নেওয়াইয়া দউবরা অর মাইয়া বিয়া দিল মতলিবের কাছে। তালাকনামা একহান আমারে দেখাইলো, ওইডা ভুয়া, নকল।
যারা গতকালকার কথা না জানত তারা সবাই সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। ভুয়া তালাকনামা, নকল!
হ ভুয়া, নকল। আমি কাইল বিয়ালে মনির সর্দার নিয়ামতউল্লাহ তাগো লইয়া তালাকনামা দেখছি, পুরা ভুয়া। কহেক টেকা খরচা কইরা কই থিকা জানি বানাইয়া লইয়াইছে।
দবির কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, আমি কাইলও কইছি, আইজও কই হুজুর, বেবাকতের সামনেঐ কই, তালাকনামা নকল না হুজুর। ভুয়া না। একদম খাঁটি। বিশ্বাস না করলে এই তালাকনামা দিয়া দিঘলি কাজির অফিসে লোক পাঠান, দরকার হইলে মালখানগর শিকদার বাড়িতে রব্বানের কাছে লোক পাঠান। পরমান করেন। যুদি ভুয়া তালাকনামা হয় তয় বিচার যা করনের করেন।
আতাহার কঠিন চোখে দবিরের দিকে তাকাল। ওই ব্যাডা, চুদুরবুদুর কথা কবি না। আমার বাপে আলেম মানুষ। সে বোঝে না কোন তালাকনামা ভুয়া আর কোনডা আসল। তারে তুই কচ পরমান করতে?
আজিজ গাওয়াল মিনমিনা গলায় বলল, আমিও মনে করি পরমান করন উচিত।
তাকে বিরাট ধমক দিল মনির সর্দার। তোমার তো বহুত সাহস দেখতাছি গাওয়াল। তোমার মায় চুন্নি আছিল দেইক্কা হুজুরে তার জানাজা পড়ে নাই, এর লেইগা তুমি গিয়া গাছির লগে দল পাকাইছো! চুপচাপ খাড়ইয়া থাকবা, একটাও কথা কইবা না।
বাপকে অপমান হইতে দেইখা নাদের হামেদ পরি জরি নিজেদের মুখের দিকে তাকাতাকি করল। পরি কোনওরকমে বলল, বাবা, তুমি চুপ থাকো।
মতি মাস্টার ছোট্ট কইরা একখান কাশ দিয়া বিনীত গলায় বললেন, তালাকনামাটা কি আমি ইকটু দেকতে পারি।
মান্নান মাওলানা কঠিন চোখে তার দিকে তাকালেন। বিরাট বিদ্যান অইয়া গেছো? আমার কথা তোমার বিশ্বাস অইতাছে না? আমি কইছি নকল তালাকনামা তারবাদে তুমি হেইডা দেখতে চাওয়ার অর্থ কী? আমারে মিথথুক পরমান করতে চাও।
মতি মাস্টারের পিছনে দাঁড়ানো মুকসেদ মতি মাস্টারের পিঠে একটা চাপ দিল। কথা কইয়েন না। তারপর বিনীত গলায় মান্নান মাওলানাকে বলল, মাস্টার সাবে ভুল কইরা বইলা ফালাইছে। আপনে তারে মাপ কইরা দেন।
নিয়ামতউল্লাহ বলল, প্যাচাইল অনেক হইতাছে হুজুর। অহন আসল বিচার শুরু করেন।
আসল বিচার হইল, মতলিব নূরজাহানের বিয়া অবৈধ। নাজায়েজ। বিয়ার নামে গত দেড়মাস ধইরা সহবাস করছে অরা। ওইটা হইল জেনা, জেনা। ব্যভিচার। আর জেনার শাস্তি হইল…।
মতি মাস্টার হাত তুললেন। হুজুর।
সবাই তার দিকে তাকাল। আমার দুই-একটা কথা ছিল হুজুর। বেয়াদবি না নিলে কইতে চাই।
মনির সর্দার তাঁকে ধমক দিতে যাবে, দুলাল বলল, সর্দার, মাস্টার সাবে কী কইতে চায় কইতে দেও। সে মাস্টার মানুষ, তার কথা আমরা শোনবো। কন মাস্টার সাব, কন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শাফী দেওবন্দী তাঁর লেখা কিতাব আল-হীলাতুন-নাজিয়া’ ফতোয়াগ্রন্থে সিদ্ধান্ত দেন যে, যে স্ত্রীর স্বামী লাপাত্তা, নিরুদ্দেশ, সেই স্ত্রী দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবে। মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শাফী দেওবন্দী পাকিস্তানের করাচির লোক। ইসলামি বিশ্বকোষের চতুর্দশ খণ্ডের ৫৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায় এই কথা আছে। সুতরাং নূরজাহানের তালাকনামা যদি ভুয়া বা নকলও হয় তাও তার বিয়া অবৈধ না। স্বামী লাপাত্তা হইয়া গেছে, সে আরেকখান বিয়া করতেই পারে!
মান্নান মাওলানা থতমত খাইয়া গেলেন। বাপকে উদ্ধার করল আতাহার। চোখ গোড়াইয়া। মতি মাস্টারের দিকে তাকায়া বলল, ওইসব কিতাব মিতাবের কথা চলবে না। বাবায় যেই বিচার করবো হেইডাঐ রাইট। এরপর আপনে আর একটাও কথা কইবেন না।
দুলালের দিকে তাকাল আতাহার। দুলাল তুইও মাস্টাররে আর আশকারা দিবি না।
দুলাল কথা বলল না। গোপনে একটা সিগ্রেট ধরাল।
মান্নান মাওলানা বললেন, সাফ কথা মতলিব নূরজাহানির বিয়া অবৈধ। অরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সহবাস করছে, ওইটা সহবাস না, জেনা। ব্যভিচার। আল্লাহপাকের কিতাব কোরান শরিফে তিনি বলেছেন, জিনাকারীগো মাটির গর্তে বুক তরি পুঁইতা একশো একটা পাথর ছুঁইড়া মারো। মাইয়ার মা-বাপরে মারো আশিটা কইরা দোররা, দোররা। আর বিয়াতে যারা সাক্ষী সুক্ষি আছিল তাগোও শাস্তি দেও। আমার রায় এইটা। আমি এই বিচারই করতে চাই। পঞ্চায়েতের ভাইরা, হাজেরানে মজলিশ, আপনেরা কী বলেন? আমি কি শরিয়তের বিধান মাইন্না বিচারডা করুম না করুম না?
দবিরের দিককার লোকজন ছাড়া, বেশিরভাগ লোকজনই মান্নান মাওলানার পক্ষ নিল। কিছু মানুষ কোনও আওয়াইজ দিল না। মনির সর্দার বলল, এইডাঐ কোরান হাদিসের বিচার, এই বিচার হইব।
নিয়ামতউল্লাহ বলল, বোরহানউদ্দিন, মাডি খোদ। দুই আড়াই হাত পরিমাণ বড় একহান গদ খোদ।
আমগাছতলায় লগে লগে কোদালের কোপ বসাইল বোরহান। সে তৈরি হইয়াই ছিল। কোদালের কোপে কোপে ঘস ঘস কইরা গর্ত করতে লাগল।