মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ খেয়াল করল, মজজিদের কাজে ঝামাইটা ভাইঙ্গা যে খোয়া সুরকি করা হইছিল, কাজ শেষ হওয়ার পর কিছু ইটা বালি আর ওই খোয়া সুরকি ভুর দিয়া রাখা হইছে ইমাম সাহেবের ঘরের উত্তর দিককার কোনায়, কদমগাছটার তলায়। মান্নান মাওলানা একবার সেই খোয়া সুরকির দিকে তাকাইলেন। দেইখা মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ দুইজনের ঠোঁটে সূক্ষ্ম একখান হাসি ফুটল। অন্যকেউ সেইটা খেয়াল করল না।
.
বোরহানউদ্দিন নামের কামলা মতন একটা লোক কোদাল হাতে আমগাছ তলায় দাঁড়ায়া আছে।
সকাল এগারোটার মতন বাজে। মাঘমাসের রোদ বেশ ভাল ভাবেই ছড়াইছে চারদিকে। চকমাঠ, গিরস্তবাড়ির উঠান পালান গাছপালা আর মজজিদবাড়ি ঝকমক ঝকমক করছে রোদে। শীতভাব কাইটা গেছে অনেক আগে। এখন রীতিমতন গরম ভাব। হইতে পারে। লোকজনের জন্য গরমটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
মান্নান মাওলানা গতকালকার সেই হাতলআলা চেয়ারে বইসা আছেন। তার পিছনে মসজিদ। দুই পাশের বেঞ্চে বইসা আছে আতাহার মনির সর্দার নিয়ামতউল্লাহ আর মতি মাস্টার। মাস্টারের পিছনে খাড়ায়া আছে মুকসেদ। অন্য বেঞ্চে এনায়েত আকবর মন্নাফ হাওলাদারের ভাইগনা দুলাল, নোয়ব আলী সাবের পোলা সৈয়দ। নূরজাহান খাড়াইয়া আছে আমগাছতলায়। তার পরনে গাঢ় দুর্বাঘাসের মতন রং একখান শাড়ি। শাড়ির পাড় লাল। আঁচলে এমন কইরা মুখ ঢাইকা রাখছে সে, দেখা যায় শুধু চোখ দুইটা।
নূরজাহানের একপাশে দবির আরেকপাশে হামিদা। মতলিব দাঁড়ায়া আছে হামিদার পাশে। আজিজ গাওয়াল আবদুল আলফু আছে মতলিবের গা ঘেঁইষা। আলফুর পাশে খাড়ায়া আছে কুট্টি। কুট্টির কোলে তার আড়াই বছরের পোলা নয়ন। নয়ন তেমন চঞ্চল স্বভাবের হয় নাই। চুপচাপ ধরনের। মা’র কোলে বইসা একবার এর মুখের দিকে আরেকবার ওর মুখের দিকে চায়। মতলা বাদলা আজ তাদের চায়ের দোকান খোলে নাই। তাদের লগে রাবি আইসা দাঁড়াইছে। বাদলা আছে পোলাপানের দলে। তার লগে আজিজ গাওয়ালের পোলাপান পরি নাদের হামেদ জরি, আবদুলের দুই পোলা আলালদ্দি আর বারেক আছে। মাইয়াটা আসে নাই, তার জ্বর। এর লেইগা মাইয়ার মা’য়ও আসে নাই। মোতালেবের বউ, হাফেজ মিস্তিরির বউ পোলাপান, মতলিবের তিন মাইয়া এরা সবাই। পরিচিত। পরিচিতর বাইরে আছে ম্যালালোক। আতাহারের পরিচিত, মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লার পরিচিত। সব মিলাইয়া চল্লিশ-পঞ্চাশজনের কম হইব না লোক।
মান্নান মাওলানার পরনে হলুদ সিল্কের পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির ওপর শাল। মাথায় টুপি। দাড়িতে একবার হাত বুলাইয়া তিনি একখান কাশ দিলেন। তারপর শুরু করলেন, পঞ্চায়েতের ভাইয়েরা আর হাজেরানে মজলিশ, আপনেরা জানেন আমি আল্লাপাকের খাসবান্দা, রসুলের খাস উম্মত। আমার কথায় এনামুল সাবে এই মজজিদ বানাইয়া দিছে যাতে এই পাড়ার নামাজিরা অন্যকোনও দিকে কষ্ট কইরা নমজ পড়তে না যায়। আমি মজজিদের ইমাম হওয়ার পর সাব্যস্ত করছি এই পাড়ায়, আমার চোক্ষের সামনে কোনও বেশরিয়তি কাম বরদাস্ত করুম না। শরিয়ত মোতাবেক বিচার করুম।
মনির সর্দার বলল, হ অবশ্যই আপনে সেইটা করবেন। আমরা মমিন মোসলমান। আমরা চাই বিচার সালিশ শরিয়ত মোতাবেকঐ হইব।
নিয়ামতউল্লাহ বলল, বেশরিয়তি কাম আমরা মাইনা লমু না।
আতাহার গম্ভীর গলায় বলল, বাবারে কইতে দেন।
মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ বলল, হ হ হুজুরেই কউক।
মান্নান মাওলানার চেয়ারের একপাশে মাটিতে নতুন একখান মোড়া। সেই গোড়া ভরতি খোয়া সুরকি। মান্নান মাওলানা একবার সেই দিকে তাকাইলেন। তারপর নূরজাহানের দিকে আঙুল তুললেন। ওই যে ছেমড়িডা মুখ ঢাইক্কা খাড়ইয়া রইছে অরে আপনেরা বেবাকতে চিনেন। দবির গাছির মাইয়া নূরজাহান। বহুত খতরনাক মাইয়া। একবার একটা চোরের লেইগা আমার মোখে ছ্যাপ দিছিল। তহন অর বয়স কম। নাদান মাইয়া। আমি অরে মাপ কইরা দিছিলাম। কী মিয়ারা, দিছিলাম না?
নূরজাহানদের দিককার লোকজন ছাড়া বেবাকতে বলল, দিছিলেন হুজুর, দিছিলেন।
অর উপরে আমি কোনও শোদ লইছি?
না হুজুর লন নাই।
দেহেন, অহনঐ একখান জিনিস পরমান হইল। আপনেরা বেবাকতে আমার কথার জব দিতাছেন, দউবরারা কইলাম দিতাছে না। খ্যাল করছেন?
মনির সর্দার বলল, হ করছি হুজুর।
দবির কোনওরকমে বলল, আমরা তো অস্বীকারও করি নাই হুজুর। মান্নান মাওলানা বিরাট একখান ধমক দিলেন। খামোশ নালায়েক। আমার কথা হোননের পর হুজুর হুজুর করনের কাম নাই।
সুরুজ দাঁড়ায়া আছে আতাহারের পিঠের সামনে। তারে অনেক কিছু শিখাইয়া পড়াইয়া আনছে আতাহার। কইছে, আমি তো বেবাক কথায় বাবার লগে তাল দিতে পারুম না। দেখতে খারাপ লাগবো। তাল দিবি তুই।
সুরুজ সেই তালটা দিল। হুজুর, কন, আপনের কথা আপনে কইয়া যান। আপনের বিচার আপনে শুরু করেন।
মান্নান মাওলানা সুরুজের দিকে তাকাইলেন না। বললেন, বিচার করনেআলা আমি একলা না। গেরাম পঞ্চায়েতের বেবাকতে। এহেনে মোমিন মোসলমান যারা আছে তারা বেবাকতে। আমি হইলাম উছিলা। মজজিদের ইমাম। শরিয়ত মোতাবেক, কোরান হাদিসে যা আছে সেই মোতাবেক বিচার আমি করুম। ইসলামি আইন অনুযায়ী করুম। ওই যে ওই ছেমড়ির কথা কইলাম, নূরজাহান, অরে আমি ওই নাদানির লেইগা মাপ কইরা দিছিলাম। কারণ আল্লাহপাক কোরান শরিফে ফরমাইছেন, না বুইজ্জা কেঐ কোনও কাম করলে, নাদানি করলে তারে তোমরা মাপ কইরা দিবা। আমি দিছি। তারবাদে ছেমড়ির একখান বিয়া হইল। বছরখানি জামাই থাকলো ঘরজামাই হইয়া, ছেমড়ির স্বভাব খারাপ এর লেইগা অরে হালাইয়া জামাই পলাইলো।