দুই বেঞ্চ দুই পাশে, মাঝখানে হাতলআলা চেয়ার। এক বেঞ্চে বসছে মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ, অন্য বেঞ্চে আজিজ গাওয়াল আবদুল আর আলফু। দবির হামিদা আর মতলিবকে বসতে দেওয়া হয় নাই।
মান্নান মাওলানার পরনে শীতের পোশাকের অন্ত নাই। গলায় মাফলার, মাথায় বান্দরটুপি আর পায়ে মোটা উলের মোজা, পামশু। খয়েরি ফ্লানেলের পাঞ্জাবির তলায় কী কী পরেছেন আল্লাই জানে, পাঞ্জাবির উপর একখান ঘিয়া রঙের শাল আছে। মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহর পরনে লুঙ্গির সঙ্গে মোটা কালো কোট। আজিজ গাওয়াল সাদা লম্বা পাঞ্জাবি পরা। মাথায় সাদা টুপি, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। পাঞ্জাবির উপর খদ্দরের সাদা চাদর। আবদুল পরেছে পুরানা হাফহাতা সোয়েটার, শুধু আলফুর পরনে শীতের কোনও পোশাক নাই। ফুলহাতা সাদা শার্ট পরা।
দবিরকে কথাটা বইলা একে একে সবার মুখের দিকে তাকালেন তিনি। সবাইকে দেখলেন। তারপর আবার তাকালেন দবিরের দিকে। কথার জব দে।
দবির একটা কাশ দিল। কী জব দিমু?
কীর লেইগা ডাকাইছি, ক?
মনে অয় মাইয়ার বিয়ার বিষয়ে।
এইত্তো বুজছস।
তারপর একটু থাইমা বললেন, তর মাইয়ার বিয়া জায়েজ অয় নাই।
দবির চমকাইল। জে।
হ। এই বিয়া অবৈধ।
হামিদা বলল, কেমতে?
তুই চুপ কর। আমি না জিগাইলে মাইয়াছেইলায় কোনও কথা কইতে পারব না, কথার জব দিতে পারব না।
দবির বলল, তয় আমি জিগাইতাছি, বিয়া নাজায়েজ হইল কেমতে? অবইধো হইল কেমতে?
আগের জামাইর কাছ থিকা তালাক না পাইলে কোনও মাইয়ার অন্য জাগায় বিয়া হইতে পারে না।
মতলিব বলল, তালাক তো পাইছে হুজুর। আমি নিজে তালাকনামা দেখছি। মুনশি সাবে দেখছেন তারবাদে বিয়া পড়াইছেন।
কো হেই তালাকনামা? দেহা আমারে। দউবরা, তালাকনামা আনছস?
দবির গম্ভীর গলায় বলল, আনছি।
বাইর কর।
চাদরের ভিতর হাত দিয়া বুক পকেট থেকে রব্বানের দেওয়া তালাকনামা বাইর করল দবির। মতলিবের লগে বিয়ার দিন পলিথিন থেকে খুইলা মুনশি সাবে দেখছিলেন তারবাদে আবার পলিথিনে প্যাঁচাইয়া দবিররে ফিরত দিছিলেন। সেই ভাবেই তালাকনামা বাইর করল দবির। পলিথিন থেকে বাইর কইরা আসল কাগজটা মান্নান মাওলানার হাতে দিল।
কাগজ হাতে নিয়া পাঞ্জাবির পকেট থেকে চশমা বাইর করলেন মান্নান মাওলানা। যেন খুবই মনোযোগ দিয়া তালাকনামা পড়ছেন, পরীক্ষা করছেন, এইভাবে কিছুক্ষণ খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া জিনিসটা দেখলেন, তারপর ছুঁইড়া ফালায়া দিলেন। এইডা ভূয়া। নকল তালাকনামা।
দবির হামিদা মতলিব তো অবাক হইলই, আজিজ গাওয়াল আবদুল আলফু তারা তিনজনও অবাক। আজিজ গাওয়াল বলল, না, নকল হইলে তো মুনশি সাবে কইতেন। তেনায় লেখাপড়া জানা মানুষ। মিছাকথা কওনের মানুষ না। মিছা বিয়া লাক টেকা দিলেও পড়াইবেন না।
আজিজকে বিরাট একখান ধমক দিলেন মান্নান মাওলানা। চুপ কর নালায়েক! আমিন মুনশি চিনাও আমারে। আরে ওইডা তো একটা পাগলাচোদা। অল্প ইট্টু বাংলা আরবি পড়ছে। গেরামে ছোট্ট একহান মাদরাসা করছে, একটা মাত্র পোলা, পোলাডা অইছে বটতলার উকিল, অরে আমি চিনি না? ও যা কইবো হেইডা আমার মানন লাগবোনি? আমি লেখাপড়া জানি না! কোরান কিতাব পড়ি না! আমার থিকা কোরান হাদিস এই গেরামে কে বেশি জানে রে? আমি বুজি না কোনডা আসল তালাকনামা আর কোন নকল? দউবরার মাইয়ার আগের জামাই বউ হালাইয়া পলাইছে। আমি খবর লইছি। আর। কোনও হদিসঐ নাই। ও তালাক দিবো কই থিকা?
দবির বলল, না না হুজুর। ও আছে। মালখানগরেঐ আছে। আমি নিজে গিয়া অর কাছ থিকা তালাকনামা আনছি। বিশ্বাস না অইলে এই তালাকনামা দিয়া কেঐরে দিঘলি পাড়ান।
এবার মান্নান মাওলানা না, দবিরকে ধমক দিল মনির সর্দার। চুপ কর বান্দির বাচ্চা। হুজুরের মুখে মুখে কথা কচ? হুজুরে না বুইজ্জা তরে কইছে তালাকনামা নকল! হুজুর তগো। থিকা কম বোজে?
নিয়ামতউল্লাহ গেল আরেক ডিগ্রি বেশি। উলটাপালটা কথা কইচ না দউবরা। তয় অহনঐ জুতাদা পিডামু।
আবদুল মিনমিনা গলায় বলল, হেয় তো কোনও উলটাপালটা কথা কয় নাই।
আবদুলকে ধমক দিলেন মান্নান মাওলানা নিজে। কথা কইচ না কইলাম হাজামের পো। গাওয়াল হাজাম চউরা, বেবাকতে মিলা গাছির লগে দল বানছো। সর্দার বানাইছো মুনশিরে! আমি আল্লার খাসবান্দা। শরিয়ত মাইন্না চলি। আমার চোক্কের সামনে বেশরিয়তি কোনও ঘটনা আমি বরদাস্ত করুম না। দউবরার মাইয়া আর মতলিবের বিয়া অবৈধ। অরা যে দেড়মাস ধইরা একলগে থাকে, সহবাস করে, এইডা জেনা, জেনা। শরিয়তে জেনার বিচার কী হেইডা আমি জানি। ওই বিচারডাই কাইল বিয়ানে আমি করুম।
মনির সর্দার বলল, তয় আমিন মুনশিরে পাইবেন না হুজুর। হেয় গেরামে নাই।
তারে আমার লাগবো না। তোমরা বেবাকতে থাকবা, পাড়ার মানুষজন থাকবো, দউবরা দউবরার বউ, মতলিব তুই তর ভুয়া বউডারে লইয়াবি। অর্থাৎ নূরজাহানিরে লইয়াবি। কাইল সকাল এগারোটায় এই মজজিদের সামনে বিচার করুম আমি। কাইল সমবার, বাংলাবোংলা বুজি না, জানুয়ারি মাসের দশ তারিখ সকাল এগারোটায় বিচার। যারা যারা দুষি তারা যুদি কেঐ উপস্থিত না থাকে, কোনও ঝামেলা করনের চেষ্টা করে তয় যেই বিচার কাইল করুম তার থিকাও একশোগুণ কঠিন বিচার করুন। সাবধান।
হামিদা কাতর অসহায় চোখে তাকাল দবিরের দিকে। দবির তার দিকে তাকাল না, যেন পাথর হইয়া গেছে। মতলিব কোনওরকমে মান্নান মাওলানার ছুঁইড়া ফালাইয়া দেওয়া তালাকনামাটা টোকাইয়া নিল। সেইটা ভাজ কইরা হাতে লইয়া ফ্যালফ্যাল কইরা চাইয়া। রইল।