হাফিজদ্দি গিয়া আতাহাররে ডাইকা আনল।
আতাহার বিনীত ভঙ্গিতে ঘরে আইসা ঢুকল। বউর লগে সম্পর্ক ভাল হওয়ার পর, দুইখান বাস নামাইয়া আরেকখান নামানের চিন্তা ভাবনা করতাছে, হাতে অগাধ টাকা পয়সা, আতাহারের চেহারায় একটা ভার ভারিক্কি ভাব আসছে। মান্নান মাওলানার ঘরে ঢুইকা বলল, ডাকছেন বাবা?
হ বয়।
আতাহার খাটের কোনায় বসল।
আমার মন থিকা ওই জিদটা যায় নাই।
কোনডা বাবা?
ওই নূরজাহানির কারবারটা। হ ওইডা যাওনের কথাও না। এর লেইগাঐ যে অরে আপনে আমার ছোটমা বানাইতে চাইছিলেন হেইডা আমি বুজছি।
তর বোজনের কথা। হেইডা যহন অয় নাই, অহন অন্য একখান পথ বাইর করছি।
কী পথ বাবা?
পরিকল্পনাটা ছেলেকে বললেন মান্নান মাওলানা। শুইনা আতাহার বলল, ব্যাপারই না। কইরা ফালান। আপনের বিচারের উপরে দিয়া কেঐ যাতে কোনও কথা কইতে না পারে হেইডা আমি দেখুম নে। আপনের পক্ষে চউরা মউরা বহুত মানুষ খাড়া করাইয়া দিমু নে। মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লারেও কইয়া দিয়েন, তারাও য্যান কিছু মানুষ জোগাড় কইরা রাখে যাতে একশো জনের মইদ্যে নব্বইজনঐ হয় আমগো লোক। তয় আর অন্য কেউ কথা কইয়া সুবিধা করতে পারবো না।
না না হেইডা পারবো না। হেই বস্তা আমি করুম নে।
মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহরে পরদিন ফজরের নামাজ শেষ কইরা বলল, আমগো পাড়ায় যে বেশরিয়তি একহান কাম হইছে হেই খবর তোমরা রাখো?
মনির সর্দার বলল, কী কাম হুজুর?
মতলিব আর নূরজাহানের বিয়া।
নিয়ামতউল্লাহ বলল, ওইডা কি বেশরিয়তি কাম হইছে হুজুর?
হইছে না?
কেমতে? মোসলমান নারী পুরুষ চাইরখান তরি বিয়া করতে পারে?
হ হেইডা পারে। তয় আগের বউ বা স্বামীর লগে তালাক হইতে হইবো।
মতলিব তো বউরে তালাক দেয় নাই। দুই বউঐ রাখছে।
সমস্যাটা সেই জাগায় না, সমস্যাটা অন্য জাগায়।
মনির সর্দার বলল, কোন জাগায় হুজুর?
নূরজাহানিরে তো আর জামাই তালাক দেয় নাই।
না না দিছে। আমি জানি। আমিন মুনশি সাবে তালাকনামা দেইখাঐ বিয়া পড়াইছে।
ওই তালাকনামা নকল।
জে?
হ। নকল তালাকনামায় নকল বিয়া হইছে। ওইডাইত্তো বেশরিয়তি কাম। মতলিবের থিকা দোষ বেশি দউবরা, তার বউ আর নূরজাহানির। মতলিবেরও দোষ আছে। আমি সালিশ বহাইতে চাই মজজিদের সামনে। শরিয়ত মতে বিচার করুম। আমি আল্লার খাশবান্দা, আমার চোক্ষের সামনে এমুন নাজায়েজ কাম চলতে পারে না। মতলিব আর নূরজাহানি যে সংসার করতাছে, ওইডা সংসার না, ওইডা জিনা, জিনা। ব্যভিচার।
মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ দুইজন দুইজনের মুখের দিকে তাকাইল। যা বোঝার বুঝল। বুইঝাই মনির সর্দার বলল, আতাহারের লগে কথা কইছেন?
কইছি। পোলায় কইলো তোমগো দুইজনের লগে কথা কইতে।
নিয়ামতউল্লাহ বলল, আমরা হুজুর আপনের লগে আছি। ওই ছেমড়ি আপনের লগে করছিল হেইডা আমরা ভুলি নাই। অহন আপনে খালি কন আমগো কী করন লাগবো।
বিচারডা আমি করুম। তোমরা আমার লগে থাকবা।
হেইডা কি আর কওন লাগবো?
তারপর আতাহারের বলা কথাগুলি বলল। শুইনা মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ দুইজনেই বলল, মানুষ দিয়া ভইরা হালামু নে। ওইডা আপনে চিন্তা কইরেন না। তয় করবেন কী হুজুর? বিচারডা হইব কেমুন?
মনের ভিতর লুকায়া রাখা ইচ্ছাটা বললেন মান্নান মাওলানা। শুইনা মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ আবার দুইজন দুইজনের মুখের দিকে তাকাইল।
মান্নান মাওলানা বললেন, তয় আগেঐ হেইডা আমরা কেঐরে বুঝতে দিমু না। গ্যাঞ্জাম লাইগ্না যাইবো।
হ ঠিক কইছেন।
তারপর বললেন, দউবরারে যে ডাকাইতে হয়। আইজ বাদ আছর এই মজজিদের সামনে ডাকো। খালি দউবরারে না, আর বউরে, এই দিকে মতলিবরেও ডাকাইবা। বিয়ার সাক্ষী, উকিলবাপ তাগোও ডাকাও। কইবা তাগো লগে আমার কথা আছে। দুইজন দুইমিহি যাও। অহন খবর দিয়া দেও। আমি আতাহাররেও থাকতে কমু নে!
আইচ্ছা।
মনির সর্দার অতি উৎসাহে মেলা দিল দবির গাছির বাড়ির দিকে, নিয়ামত হাঁটা দিল মাওয়ার বাজারের দিকে মতলিবের মুদি দোকানে গিয়া তারে খবর দিতে হইব।
.
দউবরা, তরে আর তর বউরে আমি কীর লেইগা ডাকছি, কিছু বুজছস? মনে হয় বুজছস। কারণ তর মাইয়ার নতুন জামাই মতলিবরেও ডাকছি।
দবির হামিদা আর মতলিব দাঁড়ায়া আছে মসজিদের পুবদিককার আমগাছটার তলায়, ভাঙনের দিকে। খানিক আগে আছর নামাজ শেষ হইছে। মাঘ মাসের বিকালবেলা শীত যাই যাই কইরাও যাইতাছে না। দেশ গ্রামে একখান কথা আছে ‘মাঘের শীত বাঘের গায়’। অর্থাৎ মাঘ মাসের শীতে বাঘও কাবু হয়।
আজ তেমন শীত নাই। তবু সবার গায়েই শীতের জামাকাপড়। দবির শার্টের উপর পরে আছে তুষের মতন রঙের পুরানা চাদর। হামিদারও নীল রঙের শাড়ির উপর আছে। খয়েরি রঙের মোটা চাদর। মতলিব লুঙ্গি শার্টের লগে পরছে ফুলহাতা গেরুয়া রঙের সোয়েটার।
মান্নান মাওলানা বইসা আছেন হাতলআলা একখান চেয়ারে। মসজিদের পাশে ইমাম। সাহেবের জন্য যে কামরা করা হয়েছে সেই কামরায় একটা চকি আছে, চকিতে বিছানাও আছে। চকির পাশে টেবিল আর এই চেয়ারটা। দুইটা কাঠের বেঞ্চিও আছে। বিচার সালিশের জন্য দরকার হইলে ওই ঘরেও বসা যায়।
ওই ঘরে বসা হয় নাই। মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ হুজুরের চেয়ারটা বাইরে নিয়া আসছে, বেঞ্চ দুইখান বাইরে নিয়া আসছে। মসজিদ বাড়িতে উঠতে হয় উত্তর-দক্ষিণ দিক দিয়া। পুবদিকে চক। দুই-আড়াইকানি চকের পর মহা সড়ক। অবিরাম শব্দ কইরা কইরা বাস ট্রাক যায়, মিনিবাস গাড়ি যায়, টেম্পো বেবিটেক্সি যায়। রিকশাও যায় টুংটাং ঘণ্টি বাজাইয়া।