মতলিব আর কথা বলে নাই।
মতলিবের সংসার যখন নিজের মতন কইরা সাজাইয়া গুছাইয়া, পয়পরিষ্কার কইরা, কিরনীকে নিজের বড়বোন আর তিনমেয়েকে নিজের মেয়ে বানাইয়া ফালাইছে নূরজাহান, এই খবর পাইয়া দবির হামিদা যখন বেদম খুশি, দুইদিন আইসা নূরজাহানরে দেইখা গেছে। তার ঠিক দেড়মাস পর এমন এক ঘটনা ঘটল যা কেউ কল্পনাও করে নাই।
.
দউবরারে যে ডাকাইতে হয়।
মনির সর্দার মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকাল। তার লগে আছে নিয়ামতউল্লাহ। এনামুল সাব মসজিদ করার পর কিছু কিছু নতুন মুসল্লি জুটছে মান্নান মাওলানার লগে। মোতালেব তো আছেই। মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ মোতালেবের চেয়েও বড় চামচা হইয়া দাঁড়াইছে মান্নান মাওলানার। মনির সর্দার বাড়ি করছে তালুকদার বাড়িতে। কেমন কেমন কইরা সেই বাড়িতে ঢুকছে সে। ঢুইকা নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটাইয়া কিছুটা জমি দখল কইরা বাড়ি বানাইয়া ফালাইছে। তার আসল বাড়ি সীতারামপুর। অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। সড়ক হইয়া যাওয়ার পর গত দুই বছরে টাকাপয়সার মালিক হইছে ভালই। চেহারা সুরত দেখলেই বুঝা যায় বদমাইশ টাইপের লোক। মাথায় কদমছাট দেওয়া চুল। মুখটা চালকোমড়ের মতন। কালা কুচকুচা গায়ের রং। সেই মুখ আরও কালো হয়ে আছে দাড়িমোচে। সপ্তাহে সপ্তাহে মোচদাড়িতে কলপ লাগায় সে। নাদুস নুদুস শরীরে মাঝারি মাপের হুঁড়ি। সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পইরা থাকে। পায়ে কালো রঙের পামশু। লোকটা বাইঠা (বেঁটে)।
নিয়ামতউল্লাহ লোকটা চিকন চাকন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং। চেহারা দেখলেই ধাউর মনে হয়। সেও মেদিনীমণ্ডলের লোক না। কুমারভোগ থেকে আইসা সেও কেমন কেমন কইরা ঢুইকা গেছে তালুকদার বাড়ি। একটুখানি জমি দখল কইরা ঘরদুয়ার তুইলা ফালাইছে। মনির সর্দারের লগে জমি কিনা বেচার দালালি করে। নগদ টাকাপয়সা কিছু হাতে আসার পর মান্নান মাওলানার কাছে আসছে একটা খবর শুইনা। আতাহার বাসের ব্যাবসা করব। আইজকাইল সিনডিকেট বইলা একখান জিনিস চালু হইছে, তিন-চাইরজন টাকাআলা লোক একলগে হইয়া বড় কায়কারবার করে। আমরা আতাহারের লগে থাইকা সিনডিকেট কইরা বাসের কারবার করতে চাই।
ততদিনে আতাহারের উড়নচণ্ডীভাব কইমা গেছে। কীরকম যেন একটু শান্ত শান্ত ভাব। বেসনাল থিকা ফিরা আসার পর মান্নান মাওলানা তারে ডাকাইছিল। তয় তরে শেষ বারের মতন একখান কথা কই, পারুর লগে যা হইছে সেইটা কইলাম আমার একলার ইচ্ছায় হয় নাই। তুইও আমার লগে আছিলি। কমলারে তুই নিজে দেইক্কাঐ বিয়া করছস। ওয়াজদ্দি সাবের কাছে যা যা চাইছি আমরা তারা দিছে বেবাকঐ। তারবাদে বউডার লগে তুই যা। শুরু করছস, এইডা কইলাম তর কপালে শনি টাইন্না আনবো।
আতাহার অন্যদিকে তাকায়া উদাস গলায় বলল, তয় আপনে আমারে কী করতে কন?
হুনবি আমার কথা?
আপনের কোন কথা না হুনছি?
ত্যাড়া কথা কইচ না। যা জিগাই ওইডার জব দে। হুনবি?
হুনুম।
বউর লগে আইজ থিকাঐ ভাল ব্যবহার শুরু কর। খাতির কর তার লগে। তারে পটাইয়া পাটাইয়া আরো টেকাপয়সা আন তার বাপের কাছ থিকা। তারপর বাসের কারবার শুরু কর।
আতাহার আগের মতনই উদাস গলায় বলল, আপনে কইলে করুম।
তারপর থেকে সে তাই শুরু করেছিল। কয়েকদিনের মধ্যে কমলার লগে বেদম খাতির। বউরে পুরাপুরি পটাইয়া ফালাইল। বউ লইয়া গেল গাউদ্দা। পাঁচ-সাতদিন বেড়াইয়া আরও পাঁচলাখ টাকার ব্যবস্থা কইরা আসল। তাতেও তো বড় বাস নামে না। মান্নান মাওলানা কিছু জমি বিক্রির কথাও ভাবলেন।
তখন আথকা আইসা জুটল মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ। জাগাজমিনের দালালি কইরা নগদ পাঁচ-সাত লাখ টাকা কইরা জমছে এহেক জনের হাতে। তারা সিনডিকেট কইরা আতাহারের লগে বাসের কারবার করতে চায়। মান্নান মাওলানা আর আতাহার রাজি হইয়া গেল। তয় শর্ত একটাই, কোম্পানির নাম হইব আতাহারের বউ কমলার নামে। কমলা এক্সপ্রেস।
মনির সর্দার বলল, আরে নামনোম দিয়া আমগো কিছু আহে যায় না। যা ইচ্ছা নাম রাখেন। লগে খালি আমগো রাখেন। কী কও নিয়ামত?
নিয়ামতউল্লাহরও একই কথা। হ। আমরা খালি একলগে কারবারটা করতে চাই।
একেকজনে সাতলাখ টাকা কইরা দিল প্রথমে। একটা বাস নামল। বছর ঘুরতে না। ঘুরতে এক বাসের লাভ, লগে আরও কিছু নগদ, বাস নামল আরেকখান। একটা গুলিস্থান। থেকে মেলা দেয় মাওয়ার দিকে, আরেকটা মাওয়া থেকে ছোটে গুলিস্থানের দিকে। মাওয়ায় একটা কাউন্টার, গুলিস্থানে আরেক কাউন্টার। মাওয়ার কাউন্টারে আতাহার বসাইয়া দিল তার দোস্ত নিখিলারে, গুলিস্থানের কাউন্টারে বসাইল আলমগীররে। কারণ আলমগীর বছর দুয়েক ধইরা ঢাকায়ই থাকে। এখন আতাহারের লগে চামচা হিসাবে আছে শুধু সুরুজ। ওইটা একটা গোরু। আতাহার তারে চাকরবাকরের মতন রাখছে।
এইভাবে মনির সর্দার আর নিয়ামতউল্লাহ আইসা ভিড়ছে মান্নান মাওলানার লগে। কারবার করে আতাহারের লগে, ঘোরে মান্নান মাওলানার লগে। মুসল্লি হইছে। পাঁচওক্ত নামাজ পড়ে। হুজুরের লগে লগে ঘুইরা বেড়ায়। দিনে দুই একবার মাওয়ার কাউন্টারে গিয়া নিখিলের পাশে বইসা হিসাব কিতাব দেখে।
তবে নিখিলরে লইয়া তারা একবার কথা তুলছিল। মান্নান মাওলানাকে বলছিল, হুজুর, এই মালাউনের বাচ্চাটারে আতাহার বাজানে ক্যান বসাইছে কাউন্টারে?