আজ দুপুরে সড়কের ওপাশে, পুব পাড়ার জাহিদ খাঁর বাড়ি গিয়েছিল ছনুবুড়ি। জাহিদ খাঁর ছেলের বউদের অনুনুয় করে দুপুরের ভাতটা সেই বাড়িতেই খেয়েছে। খেয়ে ফিরার সময় ছানিপড়া চোখেই দেখতে পেয়েছে বাড়ির পিছন দিককার তরিতরকারির বাগানে বাইগন (বেগুন) ধরেছে, টমাটু (টমেটো) ধরেছে। এখনও ডাঙ্গর হয়নি বাইগন, টমাটুগুলি ঘাসের মতো সবুজ, লাল হতে দিন দশবারো লাগবে। তবু চুরির লোভ সামলাতে পারেনি। বার দুই তিনেক এদিক ওদিক তাকিয়ে টুকটুক করে দুই তিনটা বাইগন ছিঁড়েছে, চার পাঁচটা টমাটু ছিঁড়েছে। তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে হাঁটা দিয়েছে।
সার্থকভাবে চুরি করবার পর মনে বেদম ফুর্তি থাকে ছনুবুড়ির। এমনিতেই দুপুরের খাওয়াটা হয়েছে ভাল, ঢেকিছাটা লক্ষ্মীদিঘা চাউলের ভাত আর খইলসা (খলিসা) মাছের সালুন (ঝোল), তার ওপর সার্থক চুরি, ছনুবুড়ির স্বভাব জেনেও বাড়ির কেউ উদিস পায়নি, পথে নেমে বুড়ি আহল্লাদে একেবারে আটখানা। বাইগন টমাটু টোপরে (কোচর) নিয়ে সন্তানের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে বুকের কাছে আর হাঁটছে খুব দ্রুত। চুরি করে বের হয়ে আসার পর ছনুবুড়ি হাঁটে একেবারে ছেমড়ির (ছুঁড়ির) মতো। বয়স নামের জুয়ান মাছটা টেনে তখন তাকে কাবু করতে পারে না।
আজও পারেনি। দ্রুত হেঁটে প্রথমে ছনুবুড়ি গেছে হাজামবাড়ি। সেই বাড়িতে বসে অনেকক্ষণ ধরে তামাক খেয়েছে। টোপরের বাইগন টমাটু একহাতে আঁকড়ে ধরা বুকের কাছে, অন্যহাতে নারকেলের ছোট্ট হুঁকা। গুরগুর গুরগুর করে যখন তামাক টানছে, হাজাম বাড়ির মুরব্বি সংসার আলী হাজামের সাইজ্জা মেয়ে (সেজোমেয়ে) তছি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা টোপরটা দেখে ফেলল। তছি জন্মপাগল। মাথার ঠিক নাই, কথাবার্তার ঠিক নাই। যুবতী বয়স কিন্তু চালচলন শিশুর মতো। ফলে তছির নাম পড়েছে তছি পাগলনী।
ছনুবুড়ির টোপরের দিকে তাকিয়ে তছি পাগলনী বলল, ও মামানি, টুপরে কী তোমার?
সংসার আলী হাজামের ছেলেমেয়েরা ছনুবুড়িকে ডাকে বুজি, তছি পাগলনী ডাকে মামানি। এই ডাকটা শুনলে পিত্তি জ্বলে যায় বুড়ির। কোথায় বুজি কোথায় মামানি! আত্মীয় অনাত্মীয় যে কাউকে বুজি ডাকা যায়, মামানি ডাকা যায় না। মামানি ডাক শুনলেই মনে হয় হাজামরা বুড়ির আত্মীয়। হাজামরা ছোটজাত। তারা কেমন করে ছনুবুড়ির আত্মীয় হয়! গ্রামের লোকে শুনলে বলবে কী! ছনুবুড়ির শ্বশুরপক্ষকে হাজাম ভাববে না তো! আজকালকার লোকেও মানুষের অতীত নিয়ে কম ঘটায় না। যা না তাই খুঁচিয়ে বের করা স্বভাবের মানুষের কী আকাল আছে গ্রামে!
এসব ভেবে রেগে গেল বুড়ি। তছি যে জন্মপাগল ভুলে গেল। হুঁকা নামিয়ে ছ্যানছ্যান করে উঠল। ঐ ছেমড়ি, তুই আমারে মামানি কচ ক্যা লো? আমি তর কেমুন মামানি।
ছনুবুড়ির সামনে, মাটিতে শিশুর মতো ল্যাছড় প্যাছড় করে বসল তছি। মাথা ভর্তি উকুন, সারাক্ষণ মাথা চুলকাচ্ছে। এখনও চুলকাল। চুলকাতে চুলকাতে বলল, কেমুন মামানি কইতে পারি না। টুপরে কী কও? কই থিকা চুরি করলা?
একে মামানি ডাক তার উপর চুরির বদলাম (বদনাম), মাথা খারাপ হয়ে গেল বুড়ির। হাতের লাঠি নিয়ে তড়বড় করে উঠে দাঁড়াল। গলা তিন চারগুণ চড়িয়ে ফেলল। আমি চোর? আমি চুরি করি, আ! হাজামজাতের মুখে এতবড় কথা?
ছনুবুড়ির রাগ চিৎকার একদম পাত্তা দিল না তছি। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে নির্বিকার গলায় বলল, তুমি তো চোর। ঐ মেন্দাবাড়ির ঝাকা থিকা হেদিনও তো তোমারে কহি (চিচিঙ্গা, এক ধরনের সবজি) চুরি করতে দেখলাম। আইজ কী চুরি করছো? দেহি টুপরে কী?
এবার চুরির কথা পাত্তা দিল না বুড়ি, মামানি নিয়ে পড়ল। ইচ্ছা কইরা মামানি কও আমারে! আত্মীয় বানাইছো, হাজাম বানাইছো আমারে! ওই মাগি, আমি কি হাজামজাতের বউঝি যে আমারে তুই মামানি কচ!
তছির বড়ভাই গোবেচারা ধরনের আবদুল তার বউ আর তছির মা তিনজনেই তখন বুড়িকে থামাবার চেষ্টা করছে। অর কথায় চেইতেন না বুজি। ও তো পাগল, কী থুইয়া কী কয়!
কীয়ের পাগল, কীয়ের পাগল ও? ভ্যাক ধরছে। অরে আমি দেখছি না তারিক্কার লগে ইরফাইন্নার ছাড়ায় ঢুকতে। পাগল অইলে এই হগল বোজেনি?
এ কথায় তছির মা ভাই স্তব্ধ হয়ে গেল। ভাইর বউ মুচকি হেসে মাথায় ঘোমটা দিল তারপর পশ্চিমের ছাপড়ায় গিয়ে ঢুকল।
তছি ততক্ষণে বুঝে গেছে তার নামে বদকথা বলছে ছনুবুড়ি। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পাগল বলে কথার পিঠে কথা বলতে শিখেনি সে, এক কথা শুনে অন্য কথা বলে। এখনও তাই করল। বিলাইয়ের (বিড়ালের মতন মুখ খিঁচিয়ে বলল, ঐ বুড়ি কূটনি, চুন্নিবুড়ি, মামানি ডাকলে শইল জ্বলে, না? হাজামরা মানুষ না! ছোডজাত? তয় এই ছোডজাতের বাইত্তে আহো ক্যা? তাগো বাইত্তে তামুক খাওনের সমায় মনে থাকে না তারা হাজাম! হাজামরা যেই উক্কায় তামুক খায় হেই উক্কায় মুখ দেও কেমতে? হাজামগো থালে বইয়া দেহি কতদিন ভাত খাইয়া গেছে! বাইর অও আমগো বাইত থন, বাইর অও। আর কুনোদিন যদি এই বাইত্তে তোমারে দেহি, টেংরি ভাইঙ্গা হালামু।
তছির মারমুখা ভঙ্গি দেখে ছনুবুড়ি থেমে গেছে। মুখে কথা আটকে গেছে তার। গো গো করতে করতে হাজামবাড়ি থেকে নেমেছে। দক্ষিণের চক ভেঙে হাঁটতে শুরু করছে। এখন শেষ বিকাল। এসময় বাড়ি ফিরা উচিত। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনালে হাঁটা চালায় অসুবিধা। ছানিপড়া চোখে এমনিতেই ঝাপসা লাগে দুনিয়া। তার উপর যদি হয় আন্ধার, পথ চলতে আছাড় উষ্ঠা খাবে ছনুবুড়ি। এই বয়সে আতুড় লুলা হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ নাই। ঘরে বসে জীবন কাটাবার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।