উত্তরের হাওয়ায় শন শন করে খাজুরডগা। সেই শব্দে দবির শোনে গাছেরা তার কথার পিঠে কথা বলছে। ভাল আছি বাজান, ভাল আছি। ব্যারাম আজাব নাই, বালা মসিবত নাই।
বর্ষাকাল শেষ হওয়ার লগে লগে খাজুরতলায় জন্মেছে টিয়াপাখি রঙের বাকসা ঘাস। কার্তিকের কোনও এক সময় সাতদিনের জন্য নামে যে বৃষ্টি, লোকে বলে কাইত্তানি, এবারের কাইত্তানির ধারায় রাতারাতি ডাঙ্গর (ডাগর) হয়েছে বাকসা ঘাস। এখন মানুষের গুড়মুড়া (গোড়ালি) ডুবে যাওয়ার মতন লম্বা। এই ঘাস ছেঁয়ে আছে মরা খাজুরডগায়। গাছের মাথায় মরে যাওয়ার পর আপনা আপনি খসে পড়েছে তলায়। পাতাগুলি খড়খড়া শুকনা কিন্তু কাঁটাগুলি শুকিয়ে যাওয়ার পরও কাঁটা। টেটার নালের মতো কটমট করে তাকিয়ে আছে। যেন তাদের আওতায় এলেই কারও আর রক্ষা নাই। খাজুরতলায় পা দিলেই সেই পা ফুটা করে শরীরে ঢুকবে, ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে কাঁটাফোটা জায়গায় কাঁথা সিলাবার সুই দিয়ে যতই ঘাটাঘাটি করুক, খাজুরকাঁটার তীক্ষ্ণ ডগার হদিস মিলবে না। সে মিশে যাবে রক্তে। রগ ধরে সারা শরীর ঘুরে বেড়াবে। দেড় দুইমাস পর বুক পিঠ ফুটা করে বের হবার চেষ্টা করবে। প্রচণ্ড ব্যথায় মানুষের তখন মরণদশা। কেউ কেউ মরেও।
সীতারামপুরের পুষ্প ঠাইরেনের (ঠাকরুনের) একমাত্র ছেলে মরেছিল খাজুরকাটায়। দুরন্ত স্বভাবের ছেলে ছিল। শীতের রাতে ইয়ার দোস্তদের নিয়া রস চুরি করতে গেছে কুমারভোগে। টর্চ মেরে মেরে এইগাছ থেকে হাড়ি নামায়, ওইগাছ থেকে নামায়। তারপর গাছতলায় দাঁড়িয়েই হাঁড়িতে চুমুক। কারও কিছু হল না, ফিরবার সময় ঠাইরেনের ছেলের ডানপায়ে ফুটল কাটা। এক দুইদিন ব্যথা হল পায়ে। ঠাইরেন নিজে সুই দিয়ে ঘাটাঘাটি করল ছেলের পা। কাঁটার দেখা পেল না। চার পাঁচদিনের মাথায় মা ছেলে দুইজনেই ভুলে গেল কাঁটার কথা। দেড়মাস পর এক সকালে পিঠের ব্যথায় চিৎকার শুরু করল ছেলে। কোন ফাঁকে শরীর অবশ হয়ে গেছে। না নড়তে পারে, না বিছানায় উঠে বসতে পারে। শবরীকলা রঙের মুখখানা সরপুটির পিত্তির মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠাইরেন কিছু বুঝতে পারে না, দিশাহারা হয়ে ডাক্তার কবিরাজ ডাকে, ফকির ফাকরা ডাকে। হোমিপ্যাথি এলাপ্যাথি, পানিপড়া, তাবিচ কবচ, হেকিমি আর কতপদের যে টোটকা, কিছুতেই কিছু হল না। পাঁচদিন ব্যথায় ছটফট করল ছেলে তারপর বিয়ানরাতের দিকে মারা গেল। পিঠের যেখানটায় ব্যথা হচ্ছিল সেই জায়গা থকথক করছে। দেখেই বোঝা যায় মাংসে পচন ধরেছে। লাশ নাড়াচাড়ার সময় চাপ পড়েছিল, চামড়া ফেটে গদ গদ করে বের হল রোয়াইল ফলের মতো রং, এমন পুঁজ। সেই পুঁজের ভিতর দেখা গেল মাথা উঁচু করে আছে একখানা খাজুরকাঁটা।
এটা অনেককাল আগের কথা। তারপর থেকে দেশগ্রামে আর রস চুরি হয় না। লোকে মনে করে খাজুরগাছ মা জননী। মা যেমন বুকের দুধ সন্তানের জন্য লুকিয়ে রাখে, খাজুরগাছ তেমন করে রস লুকিয়ে রাখে গাছির জন্য। গাছি ছাড়া অন্য কেউ এসে বুকে মুখ দিলে কাঁটার আঘাতে মা জননী তার এসপার ওসপার (এপার ওপার) করেন, জান নেন। নাহলে এই যে এতকালের পুরানা গাছি দবির, বয়স দুইকুড়ির কাছাকাছি, গাছ ঝুড়ছে পোলাপাইন্যা কাল (বালক বয়স) থেকে, কই তার পায়ে তো কখনও কাঁটা বিনলো (ফুটল) না! গাছ ঝুড়তে উঠে কাঁটার একটা খোঁচাও তো সে কখনও পায়নি!
এইসব ভেবে নৌকার মতো বেঁকা হয়ে থাকা গাছটার পায়ের কাছে বিনীত ভঙ্গিতে দুইহাত ছোঁয়াল দবির। তিনবার সালাম করল গাছটাকে। বহুকাল পর মায়ের কাছে ফিরে আসা আদুরে ছেলে যেমন করে ঠিক তেমন আকুলি বিকুলি ভঙ্গিতে গাছটাকে তারপর দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, মা মাগো, আমার মিহি (দিকে) ইট্টু নজর রাইখো মা। গরিব পোলাডার মিহি নজর রাইখো। এই দুইন্নাইতে তোমরা ছাড়া আমার মিহি চাওনের আর আছে কে! তোমরা দয়া না করলে বাচুম কেমতে! আমি তো হারা বচ্ছর তোমগো আশায় থাকি। তোমগো দয়ায় দুই তিনটা মাস সুখে কাটে। আরবছর (আগের বছর) ভালই দয়া করছিলা। এইবারও তাই কইরো মা। মাইয়া লইয়া, মাইয়ার মারে লইয়া বছরডা য্যান খাইয়া পইরা কাটাইতে পারি।
.
১.০৫
ছনুবুড়ির স্বভাব হচ্ছে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর টুকটাক চুরি করা, মিথ্যা বলা। কূটনামিতে তার কোনও জুড়ি নাই। বয়স কত হয়েছে কে জানে! শরীরটা কঞ্চির ছিপআলা বড়শিতে বড়মাছ ধরলে টেনে তোলার সময় যেমন বেঁকা হয়ে যায় তেমন বেঁকা হয়েছে। যেন এই শরীর তার নরম কঞ্চির ছিপ, মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা বয়স নামের মাছ ছিপের সঙ্গে শক্ত সুতায় ঝুলিয়ে দেওয়া বড়িশির আধার (টোপ) গিলে ভাল রকম বেকায়দায় পড়েছে। দিশাহারা হয়ে মাছ তাকে টানছে, টেনে বেঁকা করে ফেলছে। কোন ফাঁকে ভেঙে পড়বে ছিপ কেউ জানে না। টানাটানি চলছে। আর এই ফাঁকেই নিজের মতো করে জীবনটা চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি। এই গ্রাম সেই গ্রাম ঘুরছে, এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘুরছে, চুরি করছে, মিথ্যা বলছে। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে, ছনুবুড়ি আছে ভাল। মাথায় পাটের আঁশের মতো চুল, মুখে একটাও দাঁত নাই, একেবারেই ফোকলা, শরীরের চামড়া খরায় শুকিয়ে যাওয়া ডোবানালার মাটির মতো, পরনে আঠাইল্লা (এঁটেল) মাটি রঙের থান, হাতে বাঁশের একখানা লাঠি আর দুইচোখে ছানি নিয়ে কেমন করে যে এইসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি, ভাবলে তাজ্জব লাগে।