আলী আমজাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে নূরজাহানের দিকে তাকাল। হাসল। কী বোজলা? এইডা আসলে ছোট্ট একখান নমুনা দেখলা। তুমি সামনে আছিলা দেইক্কা মাত্র একটা লাথি দিছি। তুমি না থাকলে লাইথথাইয়া নিচে হালাইয়া দিতাম শালারে। শালায় ইচ্ছা কইরা বোঝা হালাইছে। য্যান অর য়োড়ায় কম মাডি দেওয়া অয়। আরামে আরামে কাম করতে পারে। আমার লগে এই হগল চালাকি চলে না। এই পড়া আমি বহুত আগে পইড়া থুইছি।
ভিতরে ভিতরে রাগে তখন ফেটে যাচ্ছে নূরজাহান। বাপের বয়সী একটা লোককে এমন লাথি মারতে পারে কেউ!
দাঁত কটমট করে নূরজাহান বলল, আপনে একটা খবিস। আপনে মানুষ না।
আমার জাগায় তুমি অইলে তুমিও এমুন করতা।
না করতাম না। যাগো দিলে রহম আছে তারা এমুন কাম করে না।
আমার দিলে নাই। নিজের লেইগা সব করতে পারি আমি।
করেন আপনের যা ইচ্ছা। আমি যাই।
নূরজাহান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আলী আমজাদ বলল, কই যাইবা?
গেরামে ঘুইরা ঘাইরা বাইত্তে যামু।
গেরামে ঘোরনের কাম কী? এহেনেই থাকো, তোমার লগে গল্প করি।
আপনে মনে করছেন রোজ রোজ সড়কে আমি আপনের লগে গল্প করতে আহি?
আলী আমজাদ সিগ্রেটে টান দিয়ে বলল, তয় ক্যান আহো?
আহি সড়ক দেকতে। মানুষজন দেকতে। সড়ক কতাহানি (কতখানি) অইলো না অইলো দেইক্কা যাই। কাইল থিকা আপনের সামনে আর আমু না। অন্য দিকদা সড়ক দেইক্কা যামু গা। আপনে মানুষ ভাল না।
আলী আমজাদ আবার হাসল। এইডা ঠিক কথা কইছো। আমি মানুষ ভাল না। বহুত বদ মানুষ আমি। যা ভাবি সেইটা কইরা ছাড়ি। টেকা পয়সা জান পরান কোনও কিছুর মায়া তহন আর করি না।
আলী আমজাদের কথা শুনে এই প্রথম ভয়ে বুক কেঁপে উঠল নূরজাহানের। অকারণে শাড়ি বুকের কাছে টানল। জড়সড় হয়ে গেল।
ব্যাপারটা খেয়াল করল আলী আমজাদ। হাসল। হাতের সিগ্রেট শেষ হয়ে আসছে। সিগ্রেটে শেষটান দিল। তারপর টোকা মেরে ফেলে দিল। আড়চোখে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে চটপটা গলায় বলল, এতক্ষুণ ধইরা নানান পদের প্যাচাইল পাড়লাম তোমার লগে, এইবার ভালকথা কই। তুমি আমার দাঁতের কথা জিগাইছিলা। সামনের একখান দাঁত পোকে খাইয়া হালাইছিলো। তহন নিজে কনটেকদারি করি না, ঢাকার বড় এক কনটেকদারের ম্যানাজারি করি। সে কইলো দাঁতের ডাক্তরের কাছে যাও, দাঁত ঠিক কইরা আহো। ডাক্তরের কাছে গেলাম, পোকড়া দাঁত হালাইয়া এই দাঁত লাগাইয়া দিলো। চাইছিলো পাথথরের দাঁত লাগাইতে, কম খরচে অইয়া যায়। আমি কইলাম, না সোনা দিয়াই বান্দান। তহন সোনার দামও কম আছিলো। আইজ কাইল তো সোনার বহুত দাম। এই দাঁতটাও দামি অইয়া গেছে।
আলী আমজাদ হাসল। এই দাঁত অহন আমার সম্পদ। বিপদ আপদে পড়লে খুইল্লা বেইচ্চা হালাইলে ভাল টেকা পামু।
নূরজাহান ঠাট্টার গলায় বলল, বেচনের আগে ভাল কইরা মাইজ্জা লইয়েন। এই রকম পচা গন্দ থাকলে সোনারুরা দাঁত কিনবো না।
আলী আমজাদ আবার হাসল। টেকা আর সোনার পচা গন্দরে গন্দ মনে করে না মাইনষে। হাতে পাইলেঐ খুশি অয়। পচা গন্দরে মনে করে আতরের গন্দ।
বাদ দেন এই সব প্যাচাইল। আমি যাই।
আড়চোখে আবার নূরজাহানকে দেখল আলী আমজাদ। কথা অন্যদিকে ঘুরাল। সড়কের কাম কবে শেষ অইবো হুইন্না যাইবা না?
নূরজাহান উদগ্রীব হয়ে আলী আমজাদের মুখের দিকে তাকাল। কবে?
দুইতিন মাসের মইধ্যে।
তারবাদে এই রাস্তা দিয়া গাড়ি চলবো?
তয় চলবো না? না চললে রাস্তা বানানের কাম কী?
কী গাড়ি চলবো?
বাস টেরাক মিনিবাস বেবিটেসকি।
আমগো গেরাম থিকা ঢাকা যাইতে কতক্ষুণ লাগবো?
ঘণ্টাহানি।
কন কী?
হ। তুমি ইচ্ছা করলে দিনে দুইবার ঢাকা গিয়া দুইবার ফিরত আইতে পারবা। অহন তো বিয়ানে মাওয়ার ঘাট থিকা লঞ্চে উটলে ঢাকা যাইতে যাইতে বিয়াল অইয়া যায়! ছিন্নগর (শ্রীনগর) দিয়া গেলে আরও আগে যাওন যায়। তয় হাঁটতে অয় অনেক।
আলী আমজাদের শেষ দিককার কথা আর কানে গেল না নূরজাহানের। আনমনা হয়ে গেল সে। স্বপ্নমাখা গলায় বলল, রাস্তা অইয়া যাওনের পর বাসে চইড়া ঢাকা যামু আমি। ঢাকার টাউন দেখনের বহুত শখ আমার।
বিকালবেলার চমৎকার এক টুকরা আলো এসে পড়েছে নূরজাহানের মুখে। সেই আলোয় অপূর্ব লাগছে মেয়েটিকে। তার শ্যামলা মিষ্টি মুখখানি, ডাগর চোখ, নাকফুল আর স্বপ্নমাখা উদাসীনতা কী রকম অপার্থিব করে তুলেছে তাকে। কুতকুতা চোখে মুগ্ধ হয়ে নূরজাহানকে দেখছে আলী আমজাদ। দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে যে ভিতরে তার জেগে উঠতে চাইছে এক অসুর, খানিক আগেও আলী আমজাদ উদিস (টের) পায়নি।
ঠিক তখনই হা হা করা উত্তরের হাওয়াটা এল। সেই হাওয়ায় আলী আমজাদের কিছু হল না, নূরজাহানের কিশোরী শরীর অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে ভরে গেল। কোনওদিকে না তাকিয়ে ছটফট করে সড়ক থেকে নামল সে। শস্যের চকমাঠ ভেঙে, ভ্রূণ থেকে মাত্র মাথা তুলেছে সবুজ ঘাসডগা, এমন ঘাসজমি ভেঙে জোয়ারে মাছের মতো ছুটতে লাগল।
.
১.০৪
মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণের নামায় এলোমেলো ভাবে ছড়ানো আটখানা খাজুর গাছ। সব কয়টা গাছই নারীগাছ। পুরুষগাছ নাই একটাও। নারী গাছে খাজুর ধরে, পুরুষ গাছে ধরে না। দুইরকম গাছের রসও দুইরকম। পুরুষ গাছের রস হয় সাদা। তেমন মিঠা না। নারী গাছের রস হালকা লাল। ভারি মিঠা। ভরা বর্ষায় গাছগুলির মাজা পর্যন্ত ওঠে পানি। কোনও কোনও বর্ষায় মাজা ছাড়িয়ে বুক ছুঁই ছুঁই। এবারের বর্ষা তেমন ছিল না। গাছগুলির মাজা ছুঁয়েই নেমে গেছে। ফলে প্রায় প্রতিটা গাছেরই মাজার কাছে সচ্ছল গিরস্ত বউর বিছার মতো লেগে আছে পানির দাগ। বয়সের ভারে নৌকার মতো বেঁকা হয়েছে যে গাছটা, বর্ষার পানি তারও পিঠ ছুঁয়েছিল। সারাবর্ষা পিঠ ছুঁয়ে থাকা পানি ভারি সুন্দর একখানা দাগ ফেলে গেছে পিঠে। এই গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর আনন্দে শ্বাস ফেলল দবির। বহুকাল পর প্রিয় মানুষের মুখ দেখলে যেমন হয়, বুকের ভিতর তেমন অনুভূতি। ভারের দুইদিকে ঝুলছে দশ বারোটা হাঁড়ি। সাবধানে ভারটা গাছতলায় নামাল সে। তারপর শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে গেল। একবার এই গাছের গায়ে পিঠে হাত বুলায়, আরেকবার ওই গাছের। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলে, মা মাগো, মা সগল, কেমুন আছো তোমরা? শইল ভাল ভো? কেঐর কোনও ব্যারাম আজাব নাই তো, বালা মসিবত নাই তো?