কাল বিকালেও কাজটা সে করেছে। তখন কে জানত একদিন পরই উত্তরের হাওয়ায় গিরস্তবাড়ির বাগান আঙিনা থেকে রসবতী খাজুরগাছেরা তাকে ডাক পাঠাবে!
ঘরে ঢুকে চঞ্চল হাতে ঠুলই নিল দবির। বাতার সঙ্গে গুঁজে রাখা মাজায় বান্ধার (কোমরে বাঁধার) মোটা কাছি নিল। আদ্যিকালের উঁচু চকির (চৌকির) তলায় যত্নে রাখা আছে রসের দশ বারোটা হাঁড়ি, হাঁড়ির সঙ্গে বাঁশের বাখারির ভার। আশ্চর্য এক নেশায় আচ্ছন্ন মানুষের মতো জিনিসগুলো বের করল দবির। লুঙ্গি কাছা মেরে মাজার পিছনে, ডানদিকে ঝুলাল ঠুলই। তারপর ভারের দুইদিকে হাড়িগুলি ঝুলিয়ে, কাছি মাফলারের মতো গলায় প্যাচিয়ে ঘর থেকে বের হল। খানিক আগে ঘরের ছায়ায় বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে এখনকার এই মানুষটার কোনও মিল নাই।
ঘর থেকে বের হয়েই বাড়ির নামার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে দবির। তার মেয়ের মা হামিদা তখন হুঁকা নিয়ে ছুটে আসছিল, এসে দেখে স্বামী গাছ ঝুড়তে যায়। তামাক খাওয়ার কথা তার মনে নাই। ফ্যাল ফ্যাল করে নামার দিকে হেঁটে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়েছে সে। ঠিক তখনই উত্তরের হাওয়া এসে মুখে ঝাঁপটা দিল। অদ্ভুত এক আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল হামিদার। রসের দিন আইয়া পড়ছে, সংসারে অহন আর কোনও অভাব থাকবো না।
.
১.০৩
ঢোল কলমির গাঢ় সবুজ পাতায় লাল রঙের লম্বা একটা ফড়িং বার বার বসছে, বার বার উড়াল দিচ্ছে। ফড়িংটার দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বলল, ও কনটেকদার সাব আপনেগো রাস্তা শেষ অইব কবে?
লোকটার নাম আলী আমজাদ। সাব কন্ট্রাক্টে মাটি কাটার কাজ করছে। সড়কের দুইপাশ থেকে মাটি কেটে তুলছে তার শতখানেক মাটিয়াল। আলী আমজাদ লেবার কন্ট্রাক্টর। নিজের মাটিয়াল নিয়ে মূল কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে করছে। লাভ ভালই থাকে। কাজ শুরুর কয়দিন পরই ফিফটি সিসির সেকেন্ডহ্যান্ড একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেলেছে। সেই মোটর সাইকেল নিয়ে সাইটে আসে। গলায় জড়ানো থাকে খয়েরি রঙের মাফলার। রোদে পোড়া কালা কুচকুচা গায়ের রঙ। ছেলেবেলায় বসন্ত হয়েছিল। গালে মুখে বসন্তের দাগ রয়ে গেছে। চোখ কুতকুতা আলী আমজাদের, শরীর দশাসই। টেটরনের নীলপ্যান্ট পরে থাকে আর সাদাশার্ট। সড়কের কাজ পাওয়ার পর হুঁড়ি বেড়েছে, পেটের কাছে শার্ট এমন টাইট হয়ে থাকে, দেখতে বিচ্ছিরি লাগে।
আলী আমজাদ ঘড়ি পরে ডানহাতে। কালা কুচকুচা লোমশ হাতে সাদা চেনের ঘড়ি বেশ ফুটে থাকে। আর তার সামনের পাটির একটা দাঁত সোনায় বাঁধানো। হাসলে মনে হয় অন্ধকার মুখের ভিতর কুপির আলো পড়েছে।
নূরজাহানের কথা শুনে হাসল আলী আমজাদ। তার হাসি দেখে আলী আমজাদকে কী জিজ্ঞাসা করেছিল ভুলে গেল নূরজাহান। আলী আমজাদের সোনায় বাঁধানো দাঁতের দিকে তাকিয়ে বলল, সোনা দিয়া দাঁত বান্দাইছেন ক্যা? হাসলে মনে অয় ব্যাটারি লাগাইয়া হাসতাছেন।
মেয়েদের কাছে এরকম কথা শুনলে লজ্জায় যে কোনও পুরুষের মুখ নিচু হয়ে যাবে। আলী আমজাদের হল না। প্রথমে হেসেছিল নিঃশব্দে, ঠোঁট ছড়িয়ে। এবার খে খে করে হাসল। দাঁত না থাকলে বান্দামু না?
কথার লগে মুখ থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ এল। দিনের পর দিন দাঁত না মাজলে এরকম গন্ধ হয় মুখে।
আলী আমজাদের মুখের গন্ধে উকাল (বমি) এল নূরজাহানের। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থু করে ছ্যাপ (থুতু) ফেলল। আগের দুইটা প্রশ্নই ভুলে গেল। প্রচণ্ড ঘৃণায় নাক মুখ কুঁচকে বলল, ইস আপনের মুখে এমুন পচা গন্দ ক্যা? দাঁত মাজেন না?
একথায়ও লজ্জা পেল না আলী আমজাদ। আগের মতোই খে খে করে হাসল। তিনখান কথা জিগাইছো। কোনডার জব (জবাব) দিমু?
আলী আমজাদ কথা শুরু করার আগেই বেশ কয়েক পা সরে দাঁড়িয়েছে নূরজাহান। যেন তার মুখের গন্ধ নাকে এসে না লাগে। ব্যাপারটা বুঝল আলী আমজাদ। বুঝেও গা করল না। বলল, কইলা না?
কী কমু?
কোন কথার জব দিমু আগে?
আপনের যেইডা ইচ্ছা।
বুক পকেট থেকে ক্যাপস্টান সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল আলী আমজাদ, ম্যাচ বের করল। সিগ্রেট ধরিয়ে হাওয়ায় ধুমা (ধোঁয়া) ছেড়ে বলল, কনটেকদারের কাম অইলো লেবারগো লগে কথা কওয়া, ধমক দেওয়া, গাইল দেওয়া। গাইল না দিলে লেবাররা কোনওদিন ঠিক মতন কাম করে না। যেই কনটেকদার লেবারগো যত বেশি গাইল দিতে পারবো সে তত বড় কনটেকদার। আমি সকাল থিকা লেবারগো গাইল্লাইতে থাকি। গাইল্লাইতে গাইল্লাইতে মুখে দুরগন্দ (দুর্গন্ধ) অইয়া যায়।
আবার সিগ্রেটে টান দিল আলী আমজাদ। খে খে করে হাসল। তয় মাইনষের মুখের গন্দও কইলাম কোনও কোনও মাইনষে পছন্দ করে।
ভুরু কুঁচকে আলী আমজাদের মুখের দিকে তাকাল নূরজাহান। কী?
হ। আমার মুখের এই গন্দ তোমার ভাবীছাবে বহুত পছন্দ করে।
নূরজাহান আবার ছ্যাপ ফেলল। আপনের বউ তো তাইলে মানুষ না। পেতনি, পেতনি।
বুড়া মতন একজন মাটিয়াল মাথায় মাটির য়োড়া (ঝুড়ি) নিয়ে সড়কের উপর দিকে উঠছিল। বোঝা তার তুলনায় ভারী। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যখন তখন উপুড় হয়ে পড়বে। হলও তাই। আলী আমজাদ আর নূরজাহানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হুড়মুড় করে পড়ল। লগে লগে ডানপা উঠে গেল আলী আমজাদের। জোরে লোকটার কোকসায় একটা লাথথি মারল। অশ্লিল একটা বকা দিল। বোরা জন্তুর মতো ভয়ে সিটকে গেল লোকটা। কাচুমাচু ভঙ্গিতে য়োড়া তুলে নামার দিকে নেমে গেল। কয়েক পলকের মধ্যে ঘটল ঘটনা। নূরজাহান বোবা হয়ে গেল।