- বইয়ের নামঃ নূরজাহান
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.০১-০৫ শেষ হেমন্তের অপরাহ্ন বেলায়
১.০১
শেষ হেমন্তের অপরাহ্ন বেলায় উত্তরের হাওয়াটা একদিন বইতে শুরু করল।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘরের ছায়ায় বসেছে দবির গাছি, হাওয়াটা গায়ে লাগল। গা কাঁটা দিয়ে উঠল। পলকে দিশাহারা হল সে। বুকের ভিতর আনচান করে উঠল। যেন উত্তরের হাওয়া বুকের ভিতরও ঢুকে গেছে তার, ঢুকে তোলপাড় করে দিয়েছে সব।
খাওয়া দাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে তামাক খায় দবির। রান্নাচালায় বসে গুছিয়ে, সুন্দর করে তামাক সাজিয়ে দেয় নূরজাহান আর নয়তো তার মা। নূরজাহান এখন বাড়িতে নাই। ঢাকা থেকে অনেক উঁচু হয়ে একটা সড়ক আসছে বিক্রমপুরের দিকে। মেদিনীমণ্ডলের পাশ দিয়ে মাওয়া হয়ে সেই সড়ক চলে যাবে খুলনায়। মাওয়ার পর রাজকীয় নদী পদ্মা। সড়কের মাঝখানে নিজের মহিমা নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকবে পদ্মা, তবু এই সড়কের নাম ঢাকা খুলনা মহাসড়ক। বিরাট একটা কারবার হচ্ছে দেশগ্রামে। কত নতুন নতুন চেহারা যে দেখা যাচ্ছে! নানান পদের মানুষে ভরে গেছে গ্রামগুলি। একটা মাত্র সড়ক রাতারাতি বদলে দিচ্ছে বিক্রমপুর অঞ্চল। শহরের হাওয়া লেগে গেছে গ্রামে। যেন গ্রাম এখন আর গ্রাম না, যেন গ্রাম হয়ে উঠছে শহর। হাজার হাজার মানুষ লেগে গেছে সড়কের কাজে। ফাঁক পেলেই সেই সড়ক দেখতে চলে যায় নূরজাহান।
আজও গেছে।
নাকেমুখে দুপুরের ভাত গুঁজে শিশুর মতো ছটফট করে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। মা বাবা কারও দিকে তাকিয়েও দেখেনি। এই ফাল্গুনে তেরো হবে নূরজাহানের। তাকে দেখায় বয়সের চেয়ে বড়। নূরজাহানের শরীর বাড়ন্ত। সীতারামপুরের হাতপাকা কারিগরদের বোনা ডুরেশাড়ি পরছে দুই বছর হল। শাড়ি পরলে বাড়ন্ত শরীরের কিশোরী চোখের পলকে যুবতী হয়ে যায়। তেমন যুবতী নূরজাহান হয়েছে দুই বছর আগে।
তবে মনের দিক দিয়ে, আচার আচরণ কথাবার্তা চালচলনে নূরজাহান শিশু। সারাক্ষণ মেতে আছে গভীর আনন্দে। গরিব গিরস্থ ঘরে জন্মে এত আনন্দ কোথায় যে পায় মানুষ!
বাড়ির উঠান পালান (আঙিনা) মাতিয়ে নূরজাহান যখন চলাফিরা করে মনে হয় না সে রক্ত মাংসের মানুষ। মনে হয় চঞ্চল পাখি।
কথায় কথায় খিলখিল করে হাসে নূরজাহান। নূরজাহানের হাসি হাসি মনে হয় না।
.
১.০২
বর্ষার মুখে পদ্মার ফুলে ওঠা পানি যখন খাল বেয়ে গ্রামে ঢোকে, এক পুকুর ভরে পানি যখন অন্য পুকুরে ঢোকার জন্য উঁকিঝুঁকি মারে, জোয়ারে মাছের লোভে দুই পুকুরের মাঝখানে যখন সরু নালা কেটে দেয় চতুর মানুষ, সেই নালা ধরে এক পুকুরের পানি যখন গিয়ে লাফিয়ে পড়ে অন্য পুকুরে, পানির সঙ্গে পানির মিলন, তখনকার যে শব্দ, নূরজাহানের হাসি তেমন। শস্যের চকমাঠ ভেঙে নূরজাহান যখন ছোটে, নূরজাহানের ছুটে যাওয়াও জোয়ারে মাছের মতো, চোখের পলকে আছে, চোখের পলকে নাই।
এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে কখনও কখনও মন উদাস হয় দবিরের। দুইদিন পর বিয়াশাদি হবে মেয়ের, কোথাকার কোন সংসারে গিয়ে পড়বে! কেমন হবে সেই সংসারের মানুষ! হাত পায়ে শিকল বেঁধে মেয়েটাকে হয়তো তারা খাঁচার পাখি বানিয়ে ফেলবে। ইচ্ছা করলেও সেই শিকল ছিঁড়তে পারবে না নূরজাহান। আস্তে ধীরে এই মুক্ত জীবনের কথা ভুলে যাবে, অভ্যস্ত হবে বন্দি জীবনে।
এইসব ভেবে মেয়েকে কখনও শাসন করে না দবির। মেয়ের মাকেও কিছু বলতে দেয় না। ফলে নূরজাহান আছে নূরজাহানের মতো।
আজ দুপুরের পর, নূরজাহান বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরের ছায়ায় বসে নূরজাহানের কথাই ভাবছিল দবির আর তামাকের অপেক্ষা করছিল। তখনই উত্তরের হাওয়াটা এল। সারাবছর এই হাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে দবির। এক শীত শেষ হলে শুরু হয় আরেক শীতের অপেক্ষা। কবে আসবে শীতকাল, কবে বইবে উত্তরের হাওয়া। কবে উত্তরের হাওয়ায় গা কাঁটা দিবে দবির গাছির, বুকের ভিতর তোলপাড় করবে। কবে উত্তরের হাওয়ায় কানের কাছে শন শন করবে খাজুরের অবোধ পাতা। দেশগ্রামের রসবতী খাজুরগাছ ডাক পাঠাবে।
আজ সেই ডাক পেল দবির, পেয়ে দিশাহারা হল। এত যে প্রিয় তামাক, খাওয়া দাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে তামাক না খেলে মনেই হয় না ভাত খাওয়া হয়েছে, খেয়ে পেট ভরেছে, সেই তামাকের কথা একদম ভুলে গেল। নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়াল। খাজুরগাছ ঝুড়ার ঠুলই আছে ঘরের পশ্চিম দিককার খামের সঙ্গে ঝুলানো। তিনচার বছরের পুরানা জিনিস। তবু এখনও বেশ মজবুত। শীতকাল শেষ হওয়ার লগে লগে যত্ন করে খামের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে দবির। ঠুলইয়ের ভিতর থাকে ছ্যান কাটাইল আর কাঠের একটা আতুর (হাতুড়ি)। আতুর দেখবার দরকার হয় না। ছ্যান কাটাইল দেখতে হয়। বর্ষাকালে যখন নিঝুম হয়ে নামে বৃষ্টি, টানা দুইদিন তিনদিন যখন বৃষ্টি থামার নামগন্ধ থাকে না, তখন ছ্যান কাটাইলে জং ধরার সম্ভাবনা। দবির মাঝে মাঝেই তখন জিনিসগুলো বের করে। অলস ভঙ্গিতে বালিকাচায় ঘষে ঘষে ধার দিয়ে রাখে ছ্যান কাটাইলে।
বর্ষা শেষ হওয়ার পর তো আর কথাই নাই। কী শরৎ কী হেমন্ত দুইদিন একদিন পর পরই বালিকাচা নিয়ে বসে দবির। মন দিয়ে বালিকাচায় ঘষে যায় ছ্যান কাটাইল।