প্রথম পর্বটা আমি শেষ করেছি। তারপরও আজই ফোন করার কোনও প্ল্যান আমার ছিল না। ইউনিভার্সিটিতে এসে শারমিনকে না পেয়ে মনের ভেতর চাড়া দিয়ে উঠল পাগলামো। ঝিনুক ও তৃণার সঙ্গে কথা বললাম। এখন ফোন করছি।
ফোন ধরল একটা ছেলে। গলার আওয়াজে বোঝা গেল কিশোর বয়সী হবে। এবং ভাষায় বোঝা গেল বাড়ির কাজের ছেলে।
হ্যালু, কারে চান?
এটা কি জাহিদুল হক সাহেবের বাড়ি।
জ্বে।
শারমিন আছে?
জ্বে না। নাই।
কোথায় গেছে?
কইতে পারি না। আপনে কে?
প্রশ্নটার উত্তর আমি এড়িয়ে যাই। কখন বেরিয়েছে বলতে পারব? মানে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে নাকি অন্য কোথাও?
ছেলেটা এবার বেশ গম্ভীর হলো। কিন্তু আপনে কে সেইটা বলতাছেন না ক্যান? সেইটা না বললে তো আপনার কথার আমি জবাব দেব না।
বুঝে গেলাম ছোকড়াটা তৃণা টাইপের। ট্যাটনা। আমি কি এখন আমার নাম বলে, মিথ্যে বানোয়াট পরিচয় দিয়ে ওর কাছ থেকে কথা বের করব! সেটা কী এমন কঠিন কাজ!
গম্ভীর গলায় বললাম, এই ছেলে, তুমি যে এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছ, তুমি জানো আমি কে? আমি শারমিনের মামাতো ভাই। আমার নাম…
নাম বলার আগেই বেশ নার্ভস গলায় ছেলেটা বলল, তয় আপনে ফুবুআম্মার সঙ্গে কথা বলেন।
বলেই ফোন নামিয়ে রেখে ফুবুআম্মা, ফুবুআম্মা বলে চিৎকার করে কাকে ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা আমি কেটে দিলাম। এখন নিশ্চয় শারমিনের নীলুফুফু এসে ফোন ধরবেন। তার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগবে না।
ততোক্ষণে বেশ দুপুর। খিদে পেয়েছে আমার। একটা ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে বিফবাৰ্গার আর কোক খেলাম। খেতে খেতেই মাথায় তৃতীয় পাগলামোটা এল আমার। আমি এখন শারমিনদের বাড়িতে যাব।
পিজির গেটের সামনে রিকশা সিএনজি ট্যাক্সিক্যাব সবই আছে। আমি একটা কালো রংয়ের ট্যাক্সিক্যাবে চড়ি। উত্তরা যান।
উত্তরা নামটি বলার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর আশ্চর্য এক অনুভূতি হয় আমার। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা মনে পড়ে।
০৩. বিয়ের কথা
আমি তোর বিয়ের কথা ভাবছি।
গভীর মনোযোগ দিয়ে মেনু দেখছিল শারমিন। বাবার কথা শুনে চমকে চোখ তুলে তাকাল। যেন কথাটা সে শুনতে পায়নি এমন গলায় বলল, কী বললে?
জাহিদ সাহেব হাসলেন। তুই বড় হয়ে গেছিস!
এতে হাসির কী হলো?
না হাসছি অন্য কথা ভেবে।
কী কথা?
আগের দিনের লোকের নামের শেষে শিক্ষাগত যোগ্যতাটা লাগিয়ে দিত। অমুক রহমান, বি এ। অনার্স থাকলে ব্রাকেটে আবার অনার্সটা লাগাত। কয়েক মাস পর তুই হচ্ছিস শারমিন হক, এম এ।
এবার শারমিনও হাসল। ব্রাকেটে অনার্সটা লাগাও। অনার্সে এত ভাল রেজাল্ট আমার আর সেটা তুমি লাগবে না!
আচ্ছা লাগালাম।
এবার ঝেরে কাশে। মানে পরিষ্কার করে বলো কী বলছিলে!
আগে খাবারের অর্ডার দে।
কাউন্টারের দিকে স্লিপপ্যাড হাতে দাড়িয়ে আছে একজন ওয়েটার। আড়চোখে শারামিনের দিকে তাকাচ্ছে। আচরণে বোঝা যায় শারমিনের অর্ডার নেয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে বেশ উদগ্রিব সে।
হাত ইসারায় লোকটিকে ডাকল শারমিন। মুহূর্তে ছুটে এল সে। খাবারের অর্ডার দিল শারমিন। কিন্তু আইটেম যেন কম মনে হলো জাহিদ সাহেবের। বললেন, এত কম অর্ডার দিলি কেন?
কম কোথায়? চারটা আইটেম।
সবই তো মনে হলো ফিস।
হ্যাঁ। প্রণ, পসফ্রেটস আর মেন্ডারিন ফিস। তুমি বলেছ আমার যা পছন্দ তাই খাবে। ভেজিটেবল রাইসের সঙ্গে এই তিনটে ফিসই খুব ভাল লাগবে।
তা বুঝলাম। দু-একটা মাংসের আইটেম দিলেও পারতি।
শারমিন গম্ভীর গলায় বলল, বাবা, তুমিই আমাকে শিখিয়েছ মাছ এবং মাংস একসঙ্গে খেতে হয় না। আমাদের বাড়িতে কোনও দিনও মাছ আর মাংস একদিনে রান্না হয় না। যেদিন মাছ হবে, শুধু মাছ। আর যেদিন মাংস শুধুই মাংস। সঙ্গে কমন আইটেম সবজি আর ডাল।
আজ একটু অনিয়ম হলেও অসুবিধা।
তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু দুজন মানুষ কত খাব! আর অপচয় আমি পছন্দ করি না।
ঠিক আছে। সফট ড্রিংকস দিতে বল। খাবারের আগে গলাটা একটু ভেজাই।
নিজের জন্য কোক আর বাবার জন্য ম্প্রাইট দিতে বলল। শারমিন। তারপর বাবার দিকে তাকাল। এবার বলো।
মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব। আবার বললেন, আমি তোর বিয়ের কথা ভাবছি।
বাবার মুখে সরাসরি নিজের বিয়ের কথা, শারমিন যেন একটু লজ্জা পেল। যদিও বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক বন্ধুর মতো, বাপ মেয়ে সাধারণত বলে না। এমন কথাও তারা দুজন কখনও কখনও বলে। তবু এই মুহূর্তে শারমিন যেন একটু লজ্জা পেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মুখটা সে নিচু করে রাখল, লজ্জাটা কাটাল, তারপর মুখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। অতি সহজ সরল গলায় বলল, যেন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, মেয়ে বড় হলে সব বাবা-মাই তার বিয়ের কথা ভাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি কি শুধুই ভেবেছ না এগিয়েছ?
কিছুটা এগিয়েছি।
মানে ঘটক লাগিয়েছ?
ঠিক ঘটক না। প্রফেশনাল ঘটক আমার পছন্দ না। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক, মানে একজন প্রকাশক, তুই তাকে দেখেছিস কিন্তু মনে আছে কি না। আমি জানি না, খান সাহেব, সে একটা সম্বন্ধ এনেছে।
সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটার কথা মনে পড়ল। শারমিনের। কেন, সে একদমই বুঝতে পারল না। একটু আনমনা হল।
শারামিনের আনমনা ভাবটা খেয়াল করলেন জাহিদ সাহেব। বললেন, তোর মা বেঁচে থাকলে আমার অনেক সুবিধা হতো।
শারমিন অবাক হল। কেমন?