রাগ ক্রোধের সঙ্গে একথাও আমার বহুবার মনে হয়েছে। তবে সেই ধাক্কার প্ৰতিশোধ আমি নিয়েছিলাম, আলমগির মামাকে ধাক্কা দিয়ে কিংবা মারপিট করে নয়, অন্যভাবে। বেশ অনেকদিন পর, শীতের শুরুর দিকে।
বিকেলের মুখে মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আমরা দুজন। আমার পরনে ইংলিশপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। আলমগির মামা পরেছে। লুঙ্গি, খালি গা কিন্তু কাঁধের ওপর ফেলা একেবারেই নতুন একটা হাওয়াই শার্ট। ওই বয়সেই আলমগির মামার ভাবভঙ্গি চালচলন বড়দের মতো। মেয়েদের নিয়ে দুএকটি অসভ্য কথাও সে বলে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নতুন পুকুরের সামনে এসেছি আমরা, ভেতরবাড়ি থেকে মেজোনোনার গম্ভীর গলার ডাক ভেসে এল। আলইমামা, ঐ আলইমামা।
নানাকে বাঘের মতো ভয় পেল আলমগির মামা। ডাক শুনে মুখটা শুকিয়ে গেল তার। এমন দিশেহারা হলো, দিকপাস না তাকিয়ে পাগলের মতো দৌড় দিল বাড়ির দিকে। দৌড়ের তালে শার্টটা যে পড়ে গেল কাঁধ থেকে, টেরই পেল না। মুহূর্তে ভেতর বাড়িতে উধাও হয়ে গেল।
আলমগির মামার শার্টের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতর ফুঁসে উঠল এক বিষাক্ত সাপ। রাগ ক্ৰোধ এবং অপমানের জ্বালায় ঘা ঘা করতে লাগল কানমুখ! কেন অমন করে আমাকে সে ধাক্কা দিয়েছিল? কী অন্যায় করেছিলাম আমি?
সেই নতুন হাওয়াই শার্টে আমি তারপর বেশ কয়েকটি বড় সাইজের মাটির ডেলা গিঁট দিয়ে বেঁধেছিলাম। পোটলার মতো করে ছুড়ে ফেলেছিলাম নতুন পুকুরে। চোখের সামনে মুহূর্তে ডুবে গিয়েছিল আলমগির মামার শার্ট।
আশ্চর্য ব্যাপার, সেই মুহূর্তেই মনটা কেমন শান্ত হয়ে গেল আমার। বুকের ভেতর জমে থাকা রাগ ক্ৰোধ কোথায় মিলিয়ে গেল। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার অপমান মুহূর্তেই যেন ভুলে গেলাম আমি। আমার শুধু মনে হলো একটু অন্যরকমভাবে প্রতিশোধটা আমি নিতে পেরেছি। আলমগির মামার প্রিয় নতুন শার্ট এমনভাবে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। কেউ কোনওদিন সেই শার্টের হদিস পাবে না। আমি ছাড়া কেউ কোনওদিন জানবে না শার্টের পরিণতি।
খুবই প্ৰফুল্ল মন নিয়ে আমি তারপর মাঠের দিকে চলে গিয়েছিলাম। সেদিন আলমগির মামার সংগে আমার আর দেখাই হয়নি। নানা বোধহয় কোথাও পাঠিয়েছিল। তাকে। পরদিন খুবই চিন্তিত গলায় সে। আমাকে বলল, আমার শার্টটা দেখছিলি মামু? দৌড়ের তালে কই যে পড়ল আর বিচড়াইয়া পাইলাম না। এই শার্টের লেইগা বাবায় যে আমারে কী পিডানডা পিডাইবো!
শুনে আমি দুঃখি দুঃখি মুখ করে বললাম, না তো! তাঁর শার্ট তো আমি দেহি নাই। আহা রে, নতুন শার্টটা তুই হারালি কেমতে? অহন তো মাইরা তার খাইতেই হইব।
দুদিন পরই সেই মারটা আলমগির মামা খেয়েছিল। গরু, চড়াবার লাঠি দিয়ে আলমগির মামাকে পেটাতে পেটাতে নানা শুধু একটা গালই দিচ্ছিলেন বউয়ার পো, এমুন বাদাইরা তুমি হইছ, নতুন শার্ট হারাইয়া ফালাও, উদিস পাও না।
মেজোনানার প্রিয়গাল ছিল বউয়ার পো। এই গালটার অর্থ খুব একটা খারাপ না। বউর ছেলে। আলমগির মামা তো যথার্থই তাই। আর বাদাইরা মানে বেহিসেবি, উদিস মানে টের পাওয়া। এগুলো বিক্রমপুরের শব্দ।
কিন্তু উঠোনে ফেলে আলমগির মামাকে যখন পিটাচ্ছিলেন নানা, বড়ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে, আর আলমগির মামার বাবা রে, গেছি রে, গেছি। রে টাইপের ত্রাহি চিৎকার শুনে আমার মনের ভেতরটা আশ্চর্য এক আনন্দে ভরে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার সেই ধাক্কার একটি নয় দুটি বড় ধরনের প্রতিশোধ আমি নিতে পেরেছি। প্রথমত শার্টটা নষ্ট করে দিয়েছি, দ্বিতীয়ত নানার হাতে বেদম একটা মার খাওয়াতে পেরেছি।
জীবনে সেই ছিল আমার প্রথম প্ৰতিশোধ নেয়া।
কিন্তু শারমিনকে কোথাও দেখছি না কেন? না ক্লাশের দিকে যেতে, না কড়িডরে, না সিঁড়ির কাছে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের এইসব জায়গাতেই তো কদিন ধরে দেখছি তাকে। তার সঙ্গের ছেলেমেয়েগুলোর কাউকে কাউকে দেখলাম। ক্লাশের দিকে যাচ্ছে কেউ, টিচার্স রুমের দিকে যাচ্ছে। দুটো মেয়েকে দেখলাম উচ্ছল ভঙ্গিতে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। এদের সঙ্গেই তো বেশির ভাগ সময় দেখি তাকে।
আজ কি সে ইউনিভার্সিটিতে আসেনি! কেন আসেনি? শরীর খারাপ। জ্বর এলো! এসময় তো বাংলাদেশে খুব জ্বরজ্বরি হয়। বড়ভাইর ছেলেটার দুদিন ধরে বেশ জ্বর।
কিন্তু শারমিনের জ্বর একথা ভাবতে আমার ভাল লাগে না। কালও তো দেখলাম। তাকে কী উচ্ছল। ছটফটে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ফেস একটি মেয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে হৈ চৈ করছে, টিএসসিতে আডিডা দিচ্ছে, হাসছে। সঙ্গের একটি ছেলেকে দেখলাম হাসতে হাসতে বই দিয়ে খুব মারল। সেই মেয়ের জ্বর আসবে কেন?
না না জ্বর হয়নি। শারমিনের। সে ভালই আছে। হয়তো ক্লাশে আসতে দেরি করছে। কিংবা জরুরি কোনও ক্লাশ নেই দেখে টিএসসাইট গিয়ে বসে আছে। কয়েকমাস পর যেহেতু মাস্টার্স ফাইনাল, এসময় জরুরি ক্লাশ নাও থাকতে পারে।
আম ইএকটা সিগ্রেট ধরাই। তারপর টানতে টিএসসির দিকে হাঁটতে থাকি।
আমি বেশ ঘন ঘন সিগ্রেট খাই। চেইনস্মোকার। আমার ব্রান্ড মার্লাবোরো। টোস্টেড মার্লাবোরো। হার্ড সিগ্রেট। সব জায়গায় পাওয়া যায় না। বায়তুল মোকাররম নিউমার্কেট গুলশান এসব জায়গায় পাওয়া যায়। তিনদিন আগে এক কার্টুন কিনেছিলাম। আজ সকালে শেষ দুপ্যাকেট নিয়ে বেরিয়েছি। ফেরার সময় নিউমার্কেট থেকে এক কার্টুন কিনে নেব।