জাহিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভাল মানুষরা বেশিদিন বেঁচে থাকে না মা, বুঝলি। তেতাল্লিশ চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন তোর মা। স্ট্রোক করল, কোমায় চলে গেল। আঠারো দিন থাকল জীবনমৃত্যুর মাঝখানে। তারপর চিরবিদায়। গতকাল সাতবছর পুরো হলো।
মৃত্যুর স্মৃতি পরিবেশ ভারি করে তোলে। বাপ মেয়ে দুজনেই কেমন উদাস হয়ে গেল। বোধহয় এই অবস্থা কাটাবার জন্যই মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব। তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে কিছু একটা যেন খেয়াল করার চেষ্টা করলেন।
বাবাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো শারমিন। কী দেখছ?
তোকে।
সঙ্গে সঙ্গে শারমিন তার স্বভাবসুলভ উচ্ছল ভঙ্গিতে বলল, আমাকে কেমন লাগছে বাবা?
ভাল, খুব ভাল। কিন্তু তোর সাজগোজের মধ্যে একটা খুঁত আছে।
কী?
তুই আজ টিপ পরিসনি। টিপ পরলে সাজটা বোধহয় কমপ্লিট হবে।
বুঝলাম। কিন্তু কমপ্লিট করে লাভ কী? সুন্দর সাজগোজ করে ঘরে বসে থাকার কোনও মানে আছে।
চল। তাহলে বাইরে কোথাও যাই।
কোথায়?
তোকে বাইরে কোথাও খাইয়ে নিয়ে আসি।
শুনে আনন্দে একেবারে লাফিয়ে উঠল। শারমিন। সত্যি? তাহলে শেরাটনে নিয়ে যাও বাবা। শেরাটনের পুলসাইটটা আমার খুব ভাল লাগে। ওখানে বসে দুজনে আমরা গল্প করব আর খাব ৷
আচ্ছা। তোকে আজ দুটো ঘটনার কথা বলব। একটা হচ্ছে তোর মায়ের মৃত্যুর সময়কার। তোর মা যখন কোমায়, হাসপাতালের বেডে না জীবিত না মৃত অবস্থায়, সে সময় একদিন ভোররাতে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখেছিলাম আমি। আমাদের এই উত্তরাতেই ঘটেছিল ঘটনাটা।
কী ঘটনা?
জাহিদ সাহেব মাত্ৰ কথা বলবেন, তার বেডসাইডে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। জাহিদ সাহেব প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন। আমরা তাহলে সাড়ে বারোটার দিকে বেরুব।
শারমিনও উঠল। আচ্ছা।
তারপর বাবার রুমে না চুকে বারান্দা দিয়ে নিজের রুমে চলে এল। এসময় আবার মনে পড়ল সেই মানুষটির কথা। কেন শারমিনকে সে ফলো করছে? কী চায়? প্ৰেম! প্ৰেম কি এইভাবে পাওয়া যায়! এইভাবে হয়! গল্প উপন্যাস সিনেমা নাটকে হয়তো হয়। বাস্তবে কি হয়!
ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় অনেকগুলো টিপ লাগানো। যখন যেটা পরে এখান থেকে নিয়েই পরে শারমিন। খুলে এখানেই লাগিয়ে রাখে। আঠা শেষ হয়ে গেলে আপনাআপনিই ঝরে যায় কোনও কোনওটা। তখন নতুন টিপ বের করতে হয়।
কিন্তু এখন যেগুলো আছে সবগুলোই প্রায় নতুন।
মাঝারি সাইজের একটা টিপ নিয়ে পরল। শারমিন। সঙ্গে সঙ্গে তার সৌন্দৰ্য যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। সত্যি এখন যেন সাজটা তার কমপ্লিট হলো। আকাশি রংয়ের শাড়ি, লালটিপ, গোলাপের মতো সৌন্দর্য সবমিলিয়ে বসন্তরাতের একটুকরো চাঁদের আলো এসে যেন ঢুকে গেছে শারমিনের রুমে। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে শারমিন মনে মনে সেই মানুষটির উদ্দেশ্যে বলল, তোমার দুর্ভাগ্য, আজ আমাকে তুমি দেখতে পেলে না। দেখলে মাথা তো খারাপ হতোই, শুধু ইউনিভার্সিটিতে না আমাকে ফলো করতে করতে তুমি নিশ্চয় এই বাড়ি পর্যন্ত চলে আসতে। আমাদের বাড়ির সঙ্গের রাস্তার ওপাশে যে বকুলগাছ ওই বকুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আমার রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে, কখন একপলক দেখতে পাবে আমাকে।
কী রে, কী বলছিস মনে মনে?
চমকে পেছন ফিরে তাকাল শারমিন। নীলুফুফু। কখন এসে ঢুকেছেন তার রুমে। হাসিমুখে ফুফুকে সে বলল, মনে মনে বলা কথা কি তুমি শুনতে পাও?
নীলু হাসলেন। হ্যাঁ, তোরটা পাই।
তাহলে বলো তো কী বলছিলাম?
বলছিলি তোর সঙ্গে যার বিয়ে হবে সে দেখতে কেমন? কী করে? কোথায় থাকে!
বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেল শারমিন। ধুৎ। আমার মনের কথা তুমি কিছুই শুনতে পাওনি। আমি বলছিলাম। একেবারেই উল্টো কথা।
কী বল তো!
এগিয়ে এসে দুহাতে ফুফুর গলা জড়িয়ে ধরল শারমিন। আমি বলছিলাম, এখন আমি ফুফুর কাছে যাব। গিয়ে বলব, ফুফু, আমি আজ ছোট্ট খুকি। তুমি আমাকে একটু কোলে নাও।
নীলু হাসলেন। ধুৎ পাগল মেয়ে।
নীলুর কথা পাত্তা দিল না শারমিন। শিশুর মতো আবদেরে গলায় বলল, ও ফুফু, নাও না আমাকে একটু কোলে। কতদিন তোমার কোলে চড়ি না।
তারপর আচমকা খিলখিল করে হাসতে লাগল।
০২. এক বসন্তকালের কথা
সেও এক বসন্তকালের কথা।
সৈয়দ মামাদের বাড়ির পশ্চিম দিককার মাঠে আলমগির মামার সঙ্গে গোল্লাছুট খেলতে গেছি। কত বয়স হবে আমার তখন! দশ! আলমগির মামাও আমার বয়সী। মার মেজোচাচার দ্বিতীয় পক্ষের ছোট ছেলে। খুবই দুরন্ত স্বভাবের, ডানপিটে ধরনের। আর আমি ছিলাম ন্যালাভোলা, গোলগাল, নিরীহ। কথা বলার স্বভাব তখন থেকেই কম। মুখে যত না বলি, মনে মনে বলি তারচে হাজার গুণ।
তো সেই বিকেলে খেলতে খেলতে অকারণেই আমাকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল আলমগির মামা। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আমার কোনও দোষ ছিল না। তবু কেন ধাক্কাটা দিল?
তেমন ব্যথা আমি পাইনি। কিন্তু রাগে ক্ৰোধে বুক ফেটে যাচ্ছিল। দুঃখও হচ্ছিল। কেন আমার সঙ্গে এমন করল আলমগির মামা!
না, আমি কাঁদিনি। মন খারাপ করে ছিলাম। আর খেলিওনি সেদিন। হয়তো সেই বিকেলেই ধাক্কা দেয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল। আলমগির মামা। কিন্তু আমি ভুলিনি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমার মনে পড়েছে সেই ধাক্কার কথা। বুকের ভেতর ফুঁসে উঠেছে রাগ, ক্ৰোধ।
কিন্তু ওই মুহূর্তে প্রতিবাদ আমি করিনি কেন? কেন আলমগির মামাকেও একটা ধাক্কা দিইনি! ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিইনি কেন? আমার গায়ে কি জোর কম ছিল! আলমগির মামার সঙ্গে কি আমি পারতাম না!