কেন বল তো?
সেদিন আকাশে বিশাল চাঁদ ছিল। আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম পূর্ণিমা রাতের সমুদ্র দেখতে।
আইডিয়াটা তোরই ছিল। ওইটুকু বয়সেই চাঁদ খুব পছন্দ করতে শুরু করেছিলি তুই। চাঁদ জ্যোৎস্না এসব দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যেত তোর।
এখনও যায়। আর সেদিন প্রথম গানটা চাঁদ নিয়েই গেয়েছিলেন তালেব আংকেল। পুরনো দিনের গান। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের, এখনও আকাশে চাঁদ ঐ জেগে আছে। চাঁদের কারণেই বোধহয় সবকিছু এত পরিষ্কার মনে আছে আমার।
তবে তালেব খুবই আন্তরিক ধরনের লোক। আমার জন্য জানটা একেবারে দিয়ে দেয়।
তারপরও মহেশখালী যাওয়ার দিন তালেব আংকেলের সঙ্গে তুমি খুব বাজে বিহেভ করেছিলে।
জাহিদ সাহেব খুবই অবাক হলেন। তাই নাকি?
হ্যাঁ। কেন, তোমার মনে নেই?
না একদম মনে নেই। কী করেছিলাম বল তো?
যে ঘাট থেকে মহেশখালী যাওয়ার কথা সেই ঘাটে যেন আগেই স্পিডবোট ঠিক করে রাখেন তালেব আংকেল…
শারমিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই চা নিয়ে এল মোবারকের মা। বাপ মেয়ের মাঝখানকার টেবিলে কাপ দুটো নামিয়ে রেখে চলে গেল।
জাহিদ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, এখন তালোবের ওপর রাগের কারণটা মনে পড়ছে। ওকে বলেছিলাম ভাল একটা স্পিডবোট রিজার্ভ করে রাখতে। সকালবেলা আমাদেরকে মহেশখালী পৌঁছে দিয়ে আসবে, বিকেলবেলা গিয়ে আবার নিয়ে আসবে। ভাড়া যা হয় নেবে। ও সেটা করেনি।
শারমিনও তার চায়ে চুমুক দিল। আরে না, করেছিল। স্পিডবোটঅলাটা ছিল ধান্দাবাজ। অন্য কে একজন বেশি পয়সা অফার করেছে, তাকে নিয়ে চলে গেছে।
ও হ্যাঁ, তাই। মনে পড়েছে।
তালেব আংকেল কিন্তু প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা বোট ঠিক করে ফেলেছিল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে চমৎকার একটা জার্নি হলো আমাদের।
চায়ে চুমুক দিয়ে একটু উদাস হলেন জাহিদ সাহেব। দূরাগত গলায় বললেন, মহেশখালী জায়গাটা বিখ্যাত আদিনাথের মন্দিরের জন্য। পাহাড়ের অনেক উপরে গাছপালা ঘেরা চমৎকার একটা পরিবেশে মন্দির। বহু বহুকালের পুরনো মন্দির। বেশ কষ্ট করে উঠতে হয়। সেই মন্দির দেখে তোর মা যে কী খুশি হয়েছিলেন!
পুরনো দিনের মন্দির টন্দির খুবই পছন্দ করতেন মা। ফেরার সময় সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়েও উঠেছিলাম। আমরা। সেই মন্দির দেখেও মা খুব খুশি।
তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে শারমিন বলল, বাবা, তোমার মনে আছে, আদিনাথের মন্দিরের ভেতর আমি আর মা ঢুকে পড়েছি, তুমি আমাদের ছবি তুলছিলে, পূজারী ভদ্রলোক খুব রেগে গিয়েছিলেন।
ঘটনাটা মনে পড়ল না জাহিদ সাহেবের। চিন্তিত গলায় বললেন, তাই নাকি! এটা তো আমার মনে নেই। আচ্ছা শোন, তোর মা যে বৃষ্টি খুব পছন্দ করতেন সেকথা তোর মনে আছে?
কী বলো, মনে থাকবে না! সিলেট থেকে তামাবিল যাচ্ছি আমরা, ইস সারাটা রাস্তায় যে কী বৃষ্টি!
সত্যি, অমন বৃষ্টি সারাজীবনেই কম দেখেছি আমি। আমরা যাচ্ছিলাম মাইক্রোবাসে। তুই আমি তোর মা আর শাহিন। মানে আমাদের সিলেটের দোকানের ম্যানেজার। সিলেট থেকে জাফলং তামাবিলের রাস্তাটা অসাধারণ। একেবারে ইউরোপ আমেরিকার রাস্তার মতো। একদম সোজা, বেশ চওড়া, বেশ স্মুথ। সেই রাস্তার দুপাশে বিশাল বিল। বর্ষার পানিতে একেবারে টইটম্বুর।
কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছিল না বৃষ্টিতে। মনে হচ্ছিল ঘন কুয়াশায় ডুবে আছে চারদিক। দশবিশ হাত দুরের জিনিসও দেখা যাচ্ছিল না। তবু যে কী এনজয় আমরা করেছি! বৃষ্টি দেখে তোর মা একেবারে মুগ্ধ। শিশুর মতো ছটফট ছটফট করছিল।
শারমিন চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। আমার মনে আছে, সব মনে আছে।
জাহিদ সাহেবও তার চা শেষ করেছেন। কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, কিন্তু তামাবিল পৌঁছাবার পর একদম বৃষ্টি নেই। ওখানে নেমে আমরা ঘুরে বেড়ালাম, ছবি তুললাম, চা খেলাম।
আমি যে একটা কাণ্ড করেছিলাম তোমার মনে আছে, বাবা?
মেয়ের মুখের দিতে তাকালেন জাহিদ সাহেব। কী বল তো?
বাংলাদেশ-ইণ্ডিয়ার বর্ডারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে বিডিআর চেকপোস্ট। একটা ঝুলন্ত বীশের এপারে বাংলাদেশ, ওপারে। ইণ্ডিয়া। বাঁশটির সামনে দাঁড়িয়ে ওপাশে একটি পা দিয়ে আমি বললাম, দেখ বাবা, আমি এখন ইণ্ডিয়াতে।
জাহিদ সাহেব হাসলেন। এখন মনে পড়ছে।
আর ফেরার সময়কার কথা তোমার মনে আছে? ওপাশের ভারতীয় আকাশ ছোয়া পাহাড় থেকে যে ছবির মতো ঝরছিল ঝরনা।
হ্যাঁ, ঝরনা দেখেও তোর মা খুব খুশি হয়েছিলেন।
তারপর দুজনেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। কিছুটা সময় কাটল নিঃশব্দে।
একসময় জাহিদ সাহেব বললেন, তোর মার মনটা খুব নরম ছিল। মানুষের জন্য খুব মায়া ছিল তার।
শারমিন বলল, ঠিকই বলেছ। তোমার মনে আছে বাবা, আমাদের বাড়িতে একটা বুয়া ছিল আছিয়া নামে। বুয়ার নদশ বছরের ছোট ভাইটি রিউমেটিক ফিবারে মরো মরো। পা দুটো অচল হয়ে গেছে। প্রায় পঙ্গু। গ্রামে গিয়ে বুয়া তার ভাইটিকে নিয়ে এল। তোমার ভয়ে উপরে আনল না, সিঁড়ির তলায় শুইয়ে রেখে উপরে এসে মারা পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আফা, আমার ভাইটারে আপনে বাঁচান।
সব মনে আছে। ছেলেটির নাম ছিল ইলতুতমিস। আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তোর মা তাকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাল। ছসাত মাস চিকিৎসা করাল। কিন্তু পুরোপুরি সেরে সে ওঠেনি, একটা পা টেনে টেনে হাঁটতো। কিন্তু বেঁচে তো গেল। তারপর কিছুদিন আমাদের বাড়িতে কাজও করেছিলে।