তাহলে যাবার দরকার কী?
শারমিন অবাক হলো। কেন বাবা?
বাড়িতেই থাক। সারাদিন বাপমেয়ে গল্প করি।
তখন আবার সেই মানুষটার কথা মনে পড়ল। শারমিনের। আজও সে নিশ্চয় আসবে। ইউনিভার্সিটিতে না গেলে শারমিনকে সে দেখতে পাবে না। আকাশি রংয়ের শাড়িতে শারমিনকে দেখলে আজ তার মাথা নিশ্চয় আরও বেশি খারাপ হবে। মুখের ভঙ্গিটা তখন কেমন হবে তার, উদাস বিষণ্ণ থাকবে নাকি একটু উজ্জ্বল হবে। চোখের তারা কি কেঁপে উঠবে তার নাকি স্থির হবে! পলক কি পড়বে না চোখে!
বাবার কথায় ইউনিভার্সিটিতে না গেলে এসবের কোনও কিছুই আজ ঘটবে না।
কিন্তু বাবা কখনও এভাবে বলেন না। তিনি একটু সিরিয়াস ধরনের মানুষ। মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে। যেমন নিজের ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারেও তেমন। ফাঁকিজুকি অলসতা এসব তাঁর চরিত্রে নেই। শারমিনকেও তিনি তাঁর মতো করেই তৈরি করেছেন। শারমিনের চরিত্রে মায়ের প্রভাব বলতে গেলে নেইই, প্রভাব যা সবই বাবার।
সেই বাবা আজ নিজে অফিসে যাচ্ছেন না, শারমিনকেও ইউনিভার্সিটিতে যেতে মানা করছেন, নিশ্চয় তাঁর মন খুব বেশি খারাপ। আজ সারাদিন মেয়ের সঙ্গে চাচ্ছেন তিনি। শারামিনের কি উচিত না বাবাকে সঙ্গ দেয়া! একদিন ইউনিভার্সিটিতে না গেলে কী এমন ক্ষতি হবে। এমন কোনও জরুরি ক্লাশও তার নেই। শুধু ওই ব্যাপারটা। ওটাই বা কী এমন ব্যাপার! আজ না হোক কাল দেখা তো তার সঙ্গে হবেই। এই আকাশি রংয়ের শাড়ি আরেকদিন না হয় পরবে শারমিন।
বাবার রুমের সঙ্গের বারান্দাটা বেশ চওড়া, সুন্দর। রেলিংয়ের ধারে ধারে টবে রাখা নানা রকমের গাছপালা। একপাশে তিনটি বেতের চেয়ার, ছোট্ট একটা টেবিল। বিকেলে সন্ধ্যায় কখনও কখনও রাতে কিংবা ছুটিছাঁটার দিনে এখানটায় মা বাবার সঙ্গে শারমিনও বসেছে অনেকদিন। কত গল্প গুজব, হাসি আনন্দ। মা মারা গেলেন, সেই হাসি আনন্দের দিন উধাও হয়ে গেল জীবন থেকে।
এখন একা একা বাবা বসে থাকেন। কোনও কোনও বিকেলে, সন্ধ্যায় কিংবা রাতে। বাবার সঙ্গে শারমিনও বসে কোনও কোনও সময়।
কিন্তু ওয়ার্কিংডেতে সকালবেলা বাবা বসে আছেন বারান্দায়, শারমিনকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে মানা করছেন, এটা সত্যি একটা রেয়ার ঘটনা।
চেয়ার টেনে বাবার মুখোমুখি বসল শারমিন। আবার সেই প্রশ্নটা করল। তোমার কী হয়েছে বাবা?
জাহিদ সাহেব বিষণ্ণমুখে হাসলেন। বললাম না কিছু হয়নি। তোর মায়ের মৃত্যুদিন ছিল…।
বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই শারমিন বলল, না, আমার মনে হয় শুধু এটাই কারণ না। অন্যকোনও কারণ আছে। নয়তো তোমার মতো লোক অফিসে যাচ্ছ না, আমাকেও ইউনিভার্সিটিতে যেতে দিচ্ছ না, বলছ আমার সঙ্গে গল্প করে দিনটা কাটাবে, এসব তোমার চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
বেমানান কাজও কখনও কখনও করতে হয়। নয়তো জীবন বড় একঘেয়ে লাগে।
আমাদের জীবনটা একটু একঘেয়েই বাবা।
কী রকম?
মোবারক আর মোবারকের মাকে নিয়ে সংসারে পাঁচজন মাত্র মানুষ আমরা। তুমি আমি আর নীলুফুফু। তুমি আছ তোমার বিজনেস নিয়ে, আমি আমার পড়াশুনা, বুয়া আর মোবারককে নিয়ে ফুফু সামলাচ্ছে সংসার। সকালবেলা তুমি আর আমি দুজন চলে যাই দুদিকে। সন্ধ্যার আগে দুজনের আর দেখাই হয় না।
তোর মা বেঁচে থাকতেও তো এমনই ছিল সংসারের চেহারা। এখন নীলু যেভাবে সংসার চালাচ্ছে তোর মাও সেভাবেই চালাতেন। সকালবেলা তখনও তুই আর আমি দুজন দুদিকে চলে যেতম।
তারপরও এতটা একঘেয়েমি সংসারে ছিল না। মা খুবই আমুদে ধরনের মানুষ ছিলেন। প্রায়ই আমাদের নিয়ে এদিক ওদিক বেড়াতে যেতেন। এই আত্মীয় বাড়ি, ওই আত্মীয় বাড়ি। লতায়পাতায় আত্মীয়রাও বিয়েশাদির দাওয়াত দিলে ভাল একটা গিফট নিয়ে চলে যেতেন। তুমি আমি দুজনেই খুব বিরক্ত হতাম। কিন্তু মা তবু যেতেন।
মা বেঁচে থাকতে বছরে দুতিনবার ঢাকার বাইরেও যাওয়া হতো আমাদের। কক্সবাজার চিটাগাং রাঙামাটি সিলেট। একবার কক্সবাজার থেকে মহেশখালী চলে গেলাম। একবার বর্ষাকালে সিলেট গিয়ে তুমুল বৃষ্টিতে জাফলং, তামাবিল চলে গেলাম। তোমার মনে আছে, বাবা?
কেন থাকবে না! সব মনে আছে।
শারমিন তারপর আচমকা বলল, চা খাবে?
খেতে পারি। নাশতার পর একবার খেয়েছি। এখন আরেকবার খেলে ভালই লাগবে।
শারমিন উঠল। বসে আসি।
ছুট কিচেনের দিকে চলে গেল শারমিন। যেভাবে গেল মুহূর্তে ঠিক সেভাবি ফিরে এল। নিজের চেয়ারে বসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, মহেশখালীতে গিয়ে আমরা যে খুব মজা করেছিলাম, সেকথা তোমার মনে আছে বাবা?
কেন থাকবে না!
তাহলে বলো তো মহেশখালীতে যাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্টটা কে করেছিল?
জাহিদ সাহেব হাসলেন। আমি কিন্তু ভুলিনি।
বাবাকে হাসতে দেখে শারমিনও হাসল। ভুলেছ কি না পরীক্ষা হোক।
তালেব।
রাইট। তালেব আংকেল।
সেবারের পুরো অ্যারেঞ্জমেন্টটাই তালেব করেছিল। শৈবালে সুইট বুক করা, হিমছড়ি যাওয়া, মহেশখালী যাওয়া, সব। তালেবদের বাড়িই তো কক্সবাজার শহরে। এবং সে খুব স্মার্ট লোক।
গানও খুব ভাল গায়।
জাহিদ সাহেব অবাক হলেন। তালেবের গানের কথা তোর মনে আছে?
বারে, থাকবে না! একরাতে তালেব আংকেলদের বাড়িতে আমাদের দাওয়াত ছিল। ব্রিতা নামে তালেব আংকেলের এক কাজিন খুব সুন্দর রান্না করেছিল। রূপচাদা ফ্রাই, সিদ্ধাডিমের একটা আইটেম, কী কী সব সামুদ্রিক মাছ, শুটকি। সেইরাতে গিটার বাজিয়ে গান গেয়েছিলেন তালেব আংকেল। এতসব আমার মনে আছে কেন, জানো বাবা?