এসময় খাবার নিয়ে এল ওয়েটার। জাহিদ সাহেব বললেন, আর একটা কোক দেবেন।
শারমিন তখন বাবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে।
জাহিদ সাহেব বললেন, ছেলেটির ছবি টবি কিছু আমি দেখিনি। তবে সব শুনে আমার ভাল লেগেছে। শিক্ষিত, টাকা পয়সাআলা ভাল ঘরের ছেলে। ভাইবোনগুলো, দুই বোন জামাই সবাই লেখাপড়া জানা। এক বোন ডাক্তার আরেক বোন ভিকারুননিসা নুনের ইংরেজির টিচার। বড় ভাই মাস্টার্স করেছে ম্যানেজম্যান্টে। মেজোটা একাউনটিংয়ে। খান সাহেব বললেন, ওরা কেউ তেমন ফর্সা না, শ্যামলা ধরনের রং সবার। তবে চেহারা টেহারা ভাল।
শুনে শারমিন মনে মনে বলল, ফর্সা রংয়ের পুরুষ আমার একদম পছন্দ না। কেমন আলু মুলার মতো লাগে। আমি পছন্দ করি ডার্ক, ম্যানলি পুরুষ।
সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটির কথা মনে পড়ল। শারমিনের সেও বেশ লম্বা, গায়ের রং কালোর দিকেই বলা যায়, আর বেশ ম্যানলি। চালচলন একেবারেই কেয়ারলেস টাইপের।
মানুষটির উদ্দেশ্যে শারমিন মনে মনে বলল, তোমার আর কোনও চান্স নেই গো! মির্জা গালিব আমাকে বোধহয় নিয়েই যাচ্ছে।
জাহিদ সাহেব খেতে খেতে বললেন, কী ভাবছিস?
মুখের খাবার শেষ করে শারমিন বলল, না কিছু না।
গালিবকে কেমন লাগল?
আচমকা এরকম একটা প্রশ্ন, শারমিন চমকাল। কেমন লাগল মানে? আমি দেখেছি নাকি?
না মানে আমার কাছ থেকে শুনে!
আমার কিছু বলার নেই। তুমি যা ভাল বুঝবে তাই।
আমার কিন্তু পছন্দ।
তা আমি বুঝেছি।
আমি কি তাহলে আগাবো?
তোমার ইচ্ছা।
তবে তোকে যে তাদের পছন্দ হবে এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।
কী করে বুঝলে।
আমি জানি, আমার মেয়ে খুব সুন্দর।
নিজের মেয়েকে সব বাবারই সুন্দর মনে হয়।
এটা ঠিক না।
কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে জানিস?
কী?
তোর দুটো ছবি আর বায়োডাটা চেয়েছিল ওরা। খান সাহেবকে দিয়েও ছিলাম। আজ সকালে ফোন করে খান সাহেব বললেন, খামটা নাকি সে খুঁজে পাচ্ছে না।
বলো কী? হারিয়ে ফেলেছে?
তাই তো বলল।
খুবই ইরেসপনসেবল লোক দেখছি।
এভাবে বলিস না। সে তো আর ইচ্ছে করে হারায়নি।
কিন্তু ব্যাপারটা খুব ভাল হয়নি বাবা। আজকাল কত ধরনের ধান্দাবাজ লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। তেমন কারও হাতে যদি আমার ছবি আর বায়োডাটা যায়, আমাকে যদি কেউ ব্লাকমেইল করে!
আরে না। কী ব্লাকমেইল করবে?
তুমি জানো না, করতে পারে।
মেয়ের প্লেটে দুটো চিংড়ি তুলে দিলেন জাহিদ সাহেব। ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না তো।
আচ্ছা ঠিক আছে ভাবব না। কিন্তু তুমি আমার ছবি পেলে কোথায়?
তোর এ্যালবাম থেকে নিয়েছি।
কই আমাকে তো কিছুই বলনি।
বলিনি ইচ্ছে করেই। ভেবেছি আগে ওদের সঙ্গে কথাটথা হোক তারপর বলব।
এখনও তো কথা হয়নি, আজ তাহলে বললে কেন?
জাহিদ সাহেব হাসলেন। ছবির জন্য।
মানে?
তোর আরও দুটো ছবি আমার লাগবে। আমার অফিসের কম্পিউটারে তোর বায়োডাটা আছে। সেখান থেকে একটা প্রিন্ট বের করে নেব। এখন তোর দুটো ছবি হলে দু-একদিনের মধ্যে খান সাহেবকে আবার পাঠাতে পারি।
আমাকে না বলেও তো ছবি নিয়ে নিতে পারতে।
তা পারতাম। আগেরবার ছবি বের করে দিয়েছিল নীলু। সেই ছবি হারিয়ে গেছে শুনে সেও কেমন একটু ভয় পেয়েছে। বললাম শারমিনের এ্যালবাম থেকে আরও দুটো ছবি এনে দে। শুনে বলল, আমি আর পারব না। পরে যখন তোমার মেয়ে সব শুনবে, আমাকে একদম খেয়ে ফেলবে। তখনই ডিসিশান নিলাম তোকে সব বলে দেব। তারপর তোর কাছ থেকেই ছবি চেয়ে নেব।
শারমিন এক চুমুক কোক খেল। তারপর মিষ্টি করে হাসল। এজন্যই আজ এখানে খাওয়াতে নিয়ে এসেছি।
জাহিদ সাহেবও হাসলেন। আরো না।
আমি ঠিকই বুঝেছি। আচ্ছা যাও, ঠিক আছে। ছবি তোমাকে আমি দেব। থ্রিাআর সাইজ, পাসপোর্ট সাইজ, যা চাও। আর যদি আমার আগের হারিয়ে যাওয়া ছবি নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়। সেই ঝামেলার জন্য কিন্তু তুমি আর খান আংকেল দায়ী থাকবে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আবার কিছুটা সময় কাটে চুপচাপ। জাহিদ সাহেব খেতে খেতে কেমন উদাস হয়ে যান।
ব্যাপারটা খেয়াল করল শারমিন। বলল, কী ভাবছ বাবা?
অন্য একটা ঘটনার কথা ভাবছি।
কী বলো তো?
সকালবেলা তোকে আজ বলেছিলাম না, দুটো ঘটনার কথা বলব! একটা তো বলে ফেললাম। তোর বিয়ে, ছবি ইত্যাদি। অন্যটাও বলে ফেলি। কেন যে কাল থেকে ঘটনাটা থেকে থেকে মনে পড়ছে। তোর মায়ের মৃত্যুদিন ছিল বলেই হয়তো মনে পড়ছে। তোর মায়ের মৃত্যুদিনের ভোরবেলাই ঘটেছিল। ঘটনাটা। সাত বছর আগে। ঠিক ভোরবেলা না, ভোর রাত বলতে পারিস। তখনও ফজরের আজান হয়নি। চারটা পাঁচ দশ মিনিট হবে। উত্তরায় আমাদের বাড়ির সামনেই ঘটেছিল।
ইস বাবা, তুমি মাঝে মাঝে এত রহস্য করে কথা বলো। এত সময় নিচ্ছ কেন বলতে। সহজ ভাষায় চট করে বলে। ফেললেই তো হয়।
হ্যাঁ বলছি। ভোররাতে হাসপাতাল থেকে ফোন এল, তোর মার অবস্থা বেশ খারাপ। নীলু ছিল তোর মায়ের কাছে। সে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করল। ভাইজান, তুমি এক্ষুণি আস। ভাবীর শরীর খুবই খারাপ। ফোন পেয়ে আমি দিশেহারার মতো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আমাদের তখন গাড়ি নেই। বাড়ি একতলা হয়েছে। দোতলার কাজ চলছে। তোর মার কথায়ই একতলা কমপ্লিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে এসে উঠেছিলাম। আমরা। তাতে সুবিধাই হয়েছিল। বাড়িতে থেকেই বাড়ির কাজ তদারক করতে পারছিলাম। কিন্তু ভোেররাতে উত্তরা থেকে ঢাকা মেডিকেলে কেমন করে যাব। তবু দিশেহারার মতো বেরিয়েছি। মেইনরোডে। গিয়ে রিকশা স্কুটার যা পাই নিয়ে নেব। ভাড়া যা নেয় নেবে। উত্তরা তখন বেশ ফ্যাকা এলাকা। এত বাড়ি টারি তৈরি হয়নি। তবে হচ্ছে। এদিক ওদিক তাকালেই আন্ডার কনস্ট্রাকশন বাড়ি দেখা যায় প্রচুর। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আমি। কোনওদিকে খেয়াল নেই। দিশেহারার মতো ছুটছি। হঠাৎ দেখি আমাদের বাড়ি বরাবর লেকের পাড়ের আবছা অন্ধকারে দুজন মানুষ একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে টালমাটাল পায়ে হাঁটছে। খানিকদূর গিয়ে লেকের ভাঙনের দিকে নেমে গেল তারা। শুধু এটুকুই আমি দেখলাম। তারপর আমার আর কিছু চোখে পড়েনি বা খেয়াল করিনি। স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়, হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে, রিকশা স্কুটার পাব কী পাব না জানি না, এই অবস্থায় অন্যকিছু কি আর খেয়াল থাকে! সেদিনই সকালবেলা তোর মা মারা গেলেন। লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম দশটার দিকে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই এসেছে। কান্নাকাটি বিলাপ চলছে বাড়িতে। ওই দৃশ্যটির কথা আমার আর মানেই নেই। তোর মাকে মাটি দিয়ে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে দেখি লেকের ওদিকটায় লোকজনের জটলা। পুলিশ এসেছে। কী ব্যাপার? লেকের ওদিকটায় একজন আধাবুড়ো লোকের লাশ ভাসছে। তার হাত-পা শক্ত দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বাধা।