- বইয়ের নামঃ গোপনে
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. শারমিন আজ
শারমিন আজ খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে।
হালকা আকাশি রংয়ের টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি। সকালবেলা গোসল করে শাড়ি পরার ফলে অপূর্ব লাগছে তাকে। যেন এই মাত্র ফুটে ওঠা এক গোলাপ।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল শারমিন। তার চুল খুব ঘন। সহজে শুকাতে চায় না। হেয়ার ড্রাইয়ার দিয়ে চুল শুকালো শারমিন। মাথার পেছন দিকে চুলগুলো গোছা করে তুলে ফুলের মতো একটা পাঞ্চক্লিপ দিয়ে আটকালো। তারপর হালকা করে গাঢ় খয়েরি রংয়ের লিপস্টিক লাগালো, বেশ মিষ্টি ধরনের একটা পারফিউম স্প্রে করল। পারফিউমের গন্ধে তার শরীর এবং রুম দুটোই ভরে গেল। সুন্দর সাজ এবং গন্ধে মন ভাল হয় মানুষের। শারমিনের একটু বেশি হলো। ড্রেসিংটেবিলের লম্বা আয়নার দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বলল, এই সাজ তুমি আজ কাকে দেখাবে?
সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষের কথা মনে পড়ল শারমিনের। কয়েকদিন ধরে শারমিনের পিছু নিয়েছে। যখনই ইউনিভার্সিটিতে এসে নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে যায়, সিঁড়ির একপাশে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে। ক্লাশ থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় দেখে দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধুদের সঙ্গে টিএসসিতে যাওয়ার সময় দুদিন হলো শারমিন খেয়াল করছে দূর থেকে মানুষটা তাকে ফলো করছে। পাঁচ ফিট সাত আট ইঞ্চি লম্বা হবে। উত্তম কুমার টাইপের গোলগোল মুখ। মাথার চুল পাতলা ধরনের, চেহারা এবং স্বাস্থ্য দুটোই মোটামুটি। ফেডেড জিনসের স্কিনটাইট প্যান্ট পরে থাকে, পায়ে খয়েরি রংয়ের বুট। বেশিরভাগ দিনই গায়ে থাকে লুজ ধরনের হাফস্লিভ শার্ট। চোখে মুখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। আর বেশ সিগ্রেট খায়। যতবারই তাকে দেখেছে শারমিন, হাতে সিগ্রেট আছে।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত মানুষটার কথা শারমিন কাউকে বলেনি। ক্লাশের বন্ধুবান্ধব কাউকে না। মানুষটা যেমনি তাকে দেখছে সেও যেন তেমনি করেই দেখছে তাকে। তারপর কোনও একদিন হয়তো তার সামনে গিয়ে দাড়াবে। চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে, আপনার ব্যাপারটা কী? আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান?
আজ সকালে কি সেই মানুষটার কথা ভেবেই আকাশি রংয়ের শাড়ি পরল শারমিন! সুন্দর করে সাজল কি তার কথা ভেবেই!
ধুৎ!
শারমিন লজা পেয়ে গেল! সে আমার কে যে তার জন্য আমি সাজব। আমি সেজেছি আমার জন্য। এই সাজ আমি এখন বাবাকে দেখাব, নীলুফুফুকে দেখাব।
নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বাবার রুমে এল শারমিন। কিন্তু বাবা রুমে নেই, তার রুমের সঙ্গে যে চওড়া সুন্দর বারান্দা সেই বারান্দায় মন খারাপ। ভঙ্গিতে বসে আছেন। শারমিন এসে তার পাশে দাঁড়াল। বাবা।
মুখ ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব। মন খারাপ। ভঙ্গিটা কেটে গেল তাঁর। মুগ্ধ গলায় বললেন, বাহ্। খুব সুন্দর লাগছে।
কিন্তু তোমার কী হয়েছে?
জাহিদ সাহেব একটু থতমত খেলেন। কী হবে? কিছু হয়নি।
নিশ্চয় হয়েছে। কাল বিকেল থেকে তোমাকে খুব অন্যমনস্ক দেখছি। এখনও কী রকম মন খারাপ করে বসে আছে।
জাহিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কারণটা বুঝিসনি?
বাবার কাধে হাত দিল শারমিন। বুঝব না। কেন? মার মৃত্যুদিন ছিল কাল।
জাহিদ সাহেব মাথা নাড়লেন। এই সেদিনের কথা, দেখতে দেখতে সাত বছর হয়ে গেল।
শারমিন কথা বলল না, মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
এই বাড়িটা উত্তরার পশ্চিমে, অনেকখানি ভেতরের দিকে। বাড়ির সঙ্গে নির্জন ধরনের একটা রাস্তা। রাস্তার পশ্চিমপাশে লেক। লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের মাঠ আর নানা রকমের গাছ, ফুল পাতাবাহারের ঝোপঝাড়। লেকের ওপারেও এপারের মতোই দৃশ্য। এসবের ওপর সকালবেলার আকাশ আজ রোদে ভেসে যাচ্ছে। বসন্তকালের মনোরম একটা হাওয়া বইছে হুহু করে।
জাহিদ সাহেব আপনমনে বললেন, সময় যে কী দ্রুত কেটে যায়! তুই তখন মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছিস আর এখন ইউনিভার্সিটির শেষ ক্লাসে। কয়েক মাস পর পরীক্ষা। লেখাপড়ার জীবন শেষ হয়ে যাবে তোর।
শারমিন বাবার দিকে তাকাল। এরকমই তো হওয়ার কথা। সাতবছর কি কম সময়! তারপরও তো সেশনজটের মধ্যে পড়েছিলাম, নয়তো আরও আগেই পড়াশুনা শেষ হতো আমার।
হাত বাড়িয়ে মেয়ের একটা হাত ধরলেন জাহিদ সাহেব। আজ কি তোর ইউনিভার্সিটি খোলা?
শারমিন হাসল। খোলা থাকবে না? হঠাৎ করে ইউনিভার্সিটি বন্ধ হবে কেন?
জাহিদ সাহেব যেন একটু লজ্জা পেলেন। তাই তো! কখন যাবি?
এই তো কিছুক্ষণ পর। দেখছি না। আমি রেডি।
জাহিদ সাহেব হাসলেন। দেখছি।
তুমি অফিসে যাবে না?
না।
শুনে খুশি হয়ে গেল শারমিন। তাহলে আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাই। ইউনিভার্সিটিতে নেমে গাড়ি ছেড়ে দেব।
জাহিদ সাহেব আনমনা গলায় বললেন, না দিলেও অসুবিধা নেই। আমি আজ কোথাও যাব না।
না বাবা, তারপরও ছেড়ে দেব। ইউনিভার্সিটি এলাকায় গাড়ি রাখা খুব রিসকি। কখন কী গণ্ডগোল লাগবে, আমাদের গাড়িটা পাবে হাতের কাছে, দেখা গেল ওটার ওপর দিয়েই যাচ্ছে সব।
একটু থেমে শারমিন বলল, আমি তাহলে বেরোই।
মাত্র পা বাড়িয়েছে শারমিন, জাহিদ সাহেব বললেন, শোন।
শারমিন ঘুরে দাঁড়াল। বলো।
তোর কি খুব জরুরি কোনও ক্লাশ আছে আজ?
না তেমন জরুরি কিছু নেই। কেন?