মুনির একটা প্যাড জোগাড় করে নিজেই লিখেছে কিংবা অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে। এখন কথা হল, এটা সে কেন করবে? তার মোটিভ কি?
ঘটনাটা যদি বিদেশে ঘটত, তাহলে একটা মোটিভ খুঁজে পাওয়া যেত। পাবলিসিটি পত্রিকায় ছাপা হত। টিভি প্রোগ্রাম হত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে, তদন্তকারী টীম বসত। এক দল বলত পুরোটাই ভাঁওতা, অন্য দল বলত, না, চাঁওতা নয়।–ব্যাপারটার মধ্যে কিছু-একটা আছে।
আমেরিকায় কানসাস সিটির এক মহিলাকে নিয়ে এ-রকম হল। ভদ্রমহিলা সেইন্ট পল স্কুলের গেম টীচার। একবার এক সপ্তাহ স্কুলে এলেন না। এক সপ্তাহ পার করে যখন এলেন তখন তাঁর চোখ-মুখ শুকিয়ে আমসি। দৃষ্টি উদভ্ৰান্ত। ডাকলে সাড়া দেনমা। দু বার-তিন বার ডাকতে হয়। ভদ্রমহিলা এক অদ্ভুত গল্প বললেন। তার মৃতা মা দুপুরবেলা হঠাৎ তাঁর বাসায় উপস্থিত। স্বাভাবিক মানুষের মতো গল্প শুরু করলেন। লাঞ্চে কি আছে জিজ্ঞেস করে শাওয়ার নিতে গেলেন। তিনি দু দিন থাকলেন। স্বাভাবিক মানুষের মতো খাওয়াদাওয়া করলেন। ঘুমুলেন। প্রচুর গল্প করলেন। তবে বাড়ি থেকে বেরুলেন না এবং নিজের মেয়েকেও বেরুতে দিলেন না। বেশির ভাগ গল্পই পরকালসংক্রান্ত। কিছু-কিছু উপদেশও দিলেন। বিশেষ কোনো উপদেশ নয়। ধর্মগ্রন্থে যে-ধরনের উপদেশ থাকে, সে-ধরনের উপদেশ। তারপর এক দিন ভরদুপুরে ফেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন।
স্কুল শিক্ষিকার এই ঘটনা নিয়ে সারা আমেরিকায় হৈচৈ পড়ে গেল। ভদ্রমহিলা লাই ডিটেকটির টেস্ট দিলেন। দেখা গেল। তিনি সত্যি কথাই বলছেন। এক দল বলা শুরু করল-লাই ডিটেকটির টেষ্ট মানসিক ব্যাধিগ্রস্তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ভদ্রমহিলা মানসিক ব্যাধিগ্ৰস্ত। ভদ্রমহিলা মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত নাকি ব্যাধিগ্রস্ত নন। তা বের করার জন্যে আবার বিশেষজ্ঞদের টীম বসল, হুলস্থূল ব্যাপার!
মুনিরের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা
মুনিরের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তবে ব্যক্তিগত বিদ্রোহের কারণেও সে এটা করতে পারে। হয়ত সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসগুলো তার পছন্দ নয়। তার অপছন্দের ব্যাপারগুলো সে অন্যদের জানাতে চায়। মিসির আলিকে দিয়ে তার শুরু। পরে অন্যদের কাছে যাবে।
মিসির আলি ঠিক করলেন, যে করেই হোক, ডাক্তার এ মল্লিককে খুঁজে বের করবেন। তাঁকে এই চিঠিটি দেখাবেন। এতে রহস্যের অনেকটা সমাধান হবার কথা। ডাক্তার এ মল্লিককে খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। যেহেতু সরকারি ডাক্তার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারবে উনি কোথায় আছেন, কোন পোষ্টে আছেন। নিশ্চয়ই তাদের ডাইরেক্টরেট আছে।
বাংলাদেশে কোনো কাজই সহজে হয় না! ডাক্তার এ মল্লিকের খোঁজ বের করতে তাঁকে বিস্তর ঝামেলা করতে হল। এ বলে ওর কাছে যান, ও বলে আজ না, সোমবারে আসুন। সোমবারে গিয়ে দেখেন, যিনি খবর দেবেন। তিনি শালার বিয়েতে চিটাগাং চলে গেছেন। শেষ পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া গেল। ডাক্তার এ মল্লিক কর্তমানে খুলনার সিভিল সার্জন। তাঁর চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষ। কিছুদিনের মধ্যেই এলপিআরে চলে যাবেন।
খুলনা যাবার ব্যবস্থাও মিসির আলি চট করে করতে পারলেন না। দুটো কোর্স ঝুলছে মাথার উপর। সেসন জট সামলাবার জন্যে স্পেশাল ক্লাস হচ্ছে। মিডটার্ম পরীক্ষা। প্রচুর খাতা জমা হয়ে আছে। খাতা দেখতে হবে। খুলনা জায়গাটাও এমন নয় যে দিনে দিনে গিয়ে চলে আসা যায়।
তিনি মনে-মনে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, মুনিরকে সঙ্গে নিয়েই খুলনা যাবেন। সেই পরিকল্পনাও কার্যকর করা যাচ্ছে না। মুনিরের দেখা নেই। সেই যে ডুব দিয়েছে, ডুবাই দিয়েছে। আর উদয় হচ্ছে না। তার ঠিকানা জানা নেই বলে যোগাযোগ করা হচ্ছে না। সে কোথায় থাকে তা একবার মনে হয় বলেছিল– এখন মনে পড়ছে না। মানুষের মস্তিষ্কের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সে খুব যত্ন করে মনে করে রাখে, প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো মুছে ফেলে। যেটেলিফোন নাম্বারটি মনে করা দরকার সেটি মনে পড়ে না, অথচ প্রয়োজন নেই এমন টেলিফোন নাম্বারগুলো একের পর এক মনে পড়তে থাকে।
ডাক্তার এ মল্লিক। মানুষটি ছোটখাট। চেহারায় বয়সের তেমন ছাপ নেই, তবে মাথার সমস্ত চুল পাকা। যেন শরতের সাদা মেঘের একটা টুকরো মাথায় নিয়ে হাসিখুশি ধরনের এক জন মানুষ বসে আছেন। ডাক্তার এ মল্লিক বললেন, আমি কি আপনাকে চিনি?
জ্বি-না। আমার নাম মিসির আলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
ও, আচ্ছা আচ্ছা, আগে বলবেন তো।
আগে বললে কি হত?
না, মানে আরো খাতির করে বসতাম।
মিসির আলি হেসে ফেললেন। হাসি থামিয়ে বললেন, আপনি যথেষ্ট খাতির করেছেন। ছুটির দিন, কোথায় যেন বেরুচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বাতিল করলেন।
বাতিল করি নি। বাতিল করলে উপায় আছে? মহিলারা সেজোগুঁজে বসে আছে। তারা আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে! হা হা হা। কি ব্যাপার বলুন।
আমি না-হয় বিকেলে আসি?
পাগল হয়েছেন? বিকেলে দুটো প্রোগ্রাম। একটা জন্মদিন, একটা বিয়ে। যা বলবার এক্ষুণি বলুন। আমার নিজের কোথাও বেরুতে ইচ্ছা করছে না। আপনি আসায় একটা অজুহাত তৈরি হল। বাড়ির মেয়েদের বলতে পারব কাজে আটকা পড়েছি। হা হা হা। আসুন, আমার একটা ব্যক্তিগত ঘর আছে, সেখানে যাই।