আপনার ছেলে। বাবার অসুখের কথা বলতে-বলতে ছেলের চোখে দেখি পানি। আপনার ছেলে বোধহয় আপনাকে খুব ভালোবাসে। দেখি, আপনার পেটটা দেখি।…
কিছু দেখতে হবে না। বদহজম থেকে হয়েছে। নিবারণদা এসেছেন, অষুধ তৈরি হচ্ছে। খাওয়ামাত্র আরাম না হলে নিবারণদা নাকি তার কবিরাজী ছেড়ে দেবেন।ডাক্তার সাহেব বাবার কথায় কোনোই কান দিলেন না। টিপেটুপে বাবার পেট দেখলেন। অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনার অ্যাপেণ্ডিসাইটিস তো পেকে। টসটস করছে। এক্ষণি কেটে ফেলতে হবে।…
বাবা অবাক হয়ে বললেন, কি বলছেন এ-সব।
যেটা সত্যি সেটাই বলছি। আশা করি আপনি বেঁচে থাকতে চান? বেঁচে থাকতে না চাইলে ভিন্ন কথা।…
সত্যি বলছেন অ্যাপেণ্ডিসাইটিস?…
হ্যাঁ, সত্যি। রাত দশটার ট্রেনে ময়মনসিং যাবার কথা ছিল, সেটা আর হতে দিলেন না। …
ডাক্তার সাহেব খসখস করে একটা কাগজে কী সব লিখলেন। আমার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, খোকা তুমি এই চিঠিটা ডাক্তার মিহিরবাবুকে দিয়ে এস। তাঁরও হেল্প লাগবে। মিহিরবাবুর বাসা চেন তো? মেয়েদের স্কুলের সামনে একতলা বাড়ি। যাও ছুটে যাও! এই তো গুড বয়!…
আমি কাগজ হাতে নিয়ে উল্কার মতো ছুটুলাম। ঘর থেকে বেরুতেই কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলাম। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। মুহূর্তের জন্যে চারদিক অন্ধকার। অন্ধকার কিছুটা কাটতেই দেখি আমি আবার আগের জায়গায় ঢাকা শহরের তিনতলার আমার ছোট্ট খুপরিতে। ভাদ্র মাসের অসহ্য গরমে আমার গা ঘামছে। ঘর অন্ধকার হলেও রাস্তার কিছু আলো এসেছে। সেই আলোয় দেখলাম পাশের ঘরের দরজা আগের মতোই বন্ধ।
মুনির চুপ করল। মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, এটাই তোমার সেই বিশেষ কথা?
জ্বি স্যার।
আর কিছু বলতে চাও না?
আর কিছু বলার নেই।
তুমি যা দেখেছ, তার ব্যাখ্যা কি খুবই সহজ নয়?
জ্বি, সহজ। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।
হ্যাঁ—স্বপ্ন।
স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল খুব অল্প হয়। কিন্তু অল্প সময়েই অনেক কিছু বলে। আইনষ্টাইনের টাইম ডাইলেশনের ব্যাপার। থিওরি অব রিলেটিভিটির অন্য এক ধরনের প্রয়োগ। তাই না?
হতে পারে, থিওরি অব রিলেটিভিটি আমার জানা নেই।
আমিও জানি না। ভাসা-ভাসা যা শুনি তাই বললাম।
তুমি যে-স্বপ্ন দেখেছ এটা হচ্ছে এক ধরনের ইচ্ছাপূরণ স্বপ্ন। তোমার অবচেতন মনে আছে তোমার বাবাকে বাঁচিয়ে তোলবার আকাষ্ঠীক্ষা। অবচেতন মনের ইচ্ছগুলিও স্বপ্নে ধরা দিয়েছে। সব সময় তা হয়। এ-জীবনে যে-সব জিনিস আমরা পাই না, অথচ যে-সব জিনিসের জন্যে গভীর কামনা বোধ করি।–স্বপ্নে তাদের পাই। তাই না?
জ্বি স্যার, তাই।
বলেই মুনির উঠে দাঁড়াল।
রাত হয়ে গেছে, আজ উঠি স্যার!
মিসির আলি লক্ষ করলেন, মুনিরের মুখ থমথম করছে। চোখের দৃষ্টি অন্য রকম। যেন এই মুহূর্তে সে কোনো-একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
মুনির।
জ্বি।
তোমার বোধহয় আরো কিছু বলার ছিল। শুধু স্বপ্নের কথা বলার জন্যে আমার কাছে আস নি।
মুনির শীতল গলায় বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন। এতটা নির্বোধ আমি না। সামান্য একটা স্বপ্ন নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করব কেন?
বল সেটা কি?
আপনাকে তো বলেছি। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব আমার হাতে একটা চিঠি লিখেদিলেন মিহির বাবুর কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে। ঐ চিঠি নিয়ে বেরুবার সময় আমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাই।
হ্যাঁ, তখন তোমার স্বপ্ন ভেঙে যায়।
জ্বি স্যার। এবং আমি দেখি চিঠিটা আমার হাতে তখনো আছে।
কী বলছি তুমি!
আমি চিঠিটা আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি।
মিসির আলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মুনির চিঠিটা টেবিলের উপর রাখল। মৃদু স্বরে বলল, রাত হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই।
তুমি যে কত বড় একটা অসম্ভব কথা বলছ, তা কি তুমি জান?
জানি স্যার।
মুনির বেরিয়ে গেল। মিসির আলি চিঠি হাতে নিলেন। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।
ছেলেটি যা বলছে, সবই কি বিশ্বাসযোগ্য? নিশ্চয়ই না! সে চমৎকার গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। ইস্টার্ন মার্কেস্টাইলে চাকরির ব্যাপারটা মিথ্যা। তিনি খোঁজ নিয়েছেন। এই মিথ্যাটা সে হয়তো নিজেকে আড়াল করবার জন্যে বলছে। মূল ঘটনা হয়তো সত্যি। কিন্তু তা কী করে হয়!
প্যাডে ডাক্তার সাহেবের নাম লেখা
প্যাডে ডাক্তার সাহেবের নাম লেখা। এ মল্লিক এমবিবিএস (অ্যাপার) মেডিকেল অফিসার, নেত্রকোণা সদর। কোনো তারিখ নেই। চিঠি লেখা হয়েছে ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে। মিহিরবাবুর নাম ইংরেজিতে। বাকি অংশ বাংলায়।
মিহিরবাবু,
জরুরিভিত্তিতে একটা অপারেশন করতে হচ্ছে। কামরুদ্দিন সাহেবের অ্যাপনডিক্স।
প্রায় র্যাপচারের পর্যায়ে আপনার সাহায্য প্রয়োজন। হাসপাতালে চলে আসুন। হাসপাতালে অপারেশনের সরঞ্জাম অপ্রতুল। তবু করতে হবে। এই উকিল সাহেবের কাছে আমি নানান বিষয়ে ঋণী।
এ মল্লিক
এই চিঠি মিসির আলি খুব কম করেও পঞ্চাশ বার পড়েছেন। তাতে নতুন কোনো তথ্য বের হয়ে আসে নি। যিনি এই চিঠি লিখেছেন, তাঁর চরিত্র সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে মনে হচ্ছে, ভদ্রলোকের বেশি কথা বলার অভ্যাস আছে। জরুরি অবস্থায় তিনি চিঠি লিখছেন, তবু সেখানেও কিছু ফালতু কথা আছে, যেমন–এই উকিল সাহেবের কাছে আমি নানান বিষয়ে ঋণী। সঙ্কটের সময়ে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যই দিই, অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিই না! ইনি দিচ্ছেন। যে-জন্যে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, চিঠিটা হয়তো ডাক্তার সাহেবের লেখা নয়।