কিন্তু তা সে জানে না! কেন জানে না? মানুষের যে অংশ অসীমকে ধারণ করে অর্থাৎ মস্তিষ্কের সেই অংশ পুরোপুরি কাজ করে না বলেই সে জানে না। তার মস্তিষ্কের অংশমাত্র ব্যবহার করে, এটা তো আজ বিজ্ঞানীদের কাছে সত্য। মস্তিষ্কের একটি বিশাল অংশের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা নেই। কারণ সেই অংশটি সুপ্ত।
কারো-কারো ক্ষেত্রে সুপ্ত অংশ কিছুটা জেগে ওঠে। তার চারপাশের অসীম জগৎ সম্পর্কে সে কিছুটা ধারণা পেতে থাকে। যেমন মুনির পাচ্ছে।
থিওরি হিসেবে এটা কেমন? মোটেই সুবিধের নয়। মিসির আলি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন। একটি থিওরি দাঁড় করাতে ধর্মগ্রন্থের সাহায্য নেয়াটাই তাঁর অপছন্দ। যে কোনো থিওরি বা হাইপোথিসিস দাঁড়ায় লজিকের ওপর।–অন্য কোনো কিছুর ওপরে নয়। ধর্মগ্রন্থের ওপরে তো নয়ই।
মিসির আলির বিরক্তি আরো বাড়ল। মুনিরের সমস্যাটিকে আর কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। নিজের ওপরই কেমন যেন রাগ হচ্ছে।
তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে খাম, খুলে চিঠি বের করলেন। সেখানে লেখা–
স্যার,
আমি খুব অসুস্থ। আমাকে কি আপনি দেখতে আসবেন? আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি পিিজতে। ওয়ার্ড নম্বর তিন শ ছয়।
টুনু।
এই টুনু যে মুনির, এটা ধরতেও তাঁর অনেক সময় লাগল। অনেক দিন থেকেই তিনি মুনিরের খবর রাখেন না। নিজের পড়াশোনা এবং চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত। মুনিরও যে তাঁর কাছে আসছে না, এটা তিনি লক্ষ করেন নি। কোনো-একটা কাজ নিয়ে ডুবে থাকলে তাঁর এ-রকম হয়।
নিজের ওপর তাঁর বিরক্তি লাগছে। দরজায় করা যেন ছায়া পড়েছে। তিনি দরজার দিকে না তাকিয়েই বললেন, এস নীলু।
নীলু হালকা গলায় বলল, আমি আসায় কি আপনি বিরক্ত হয়েছেন?
হ্যাঁ, হয়েছি। এখন এক জায়গায় যাচ্ছি। তুমি আসায় আটকা পড়লাম।
আমি আপনাকে আটকাবার জন্যে আসি নি। যেখানে যাচ্ছেন যান!
তুমি তাহলে অপেক্ষা কর-আমি চট করে কাপড় বদলে আসি। তোমার হাতে কি?
চা-পাতা। খুব ভালো চা। সিলেটে আমার এক মামা আছেন। চা বাগানে কাজ করেন। তিনি পাঠিয়েছেন।
থ্যাঙ্কস্।
আপনি কাপড় বদলাতে-বদলাতে কি আমি চট করে আপনার জন্যে এক কাপ চা বানাব?
না, দেরি হয়ে যাবে।
মিসির আলি তৈরি হয়ে বেরুতে যাবার সময় নীলু বলল, আমি এখানে থাকব, আপনি ঘুরে আসুন।
তুমি এখানে থাকবে মানে?
আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।
আমি কখন ফিরব, তার কি কোনো ঠিক আছে?
যত দেরিই হোক অপেক্ষা করব।
একা-একা?
হ্যাঁ, এক-একা। আপনি এক-একা থাকতে পারলে আমি পারব না কেন?
মিসির আলি কথা বাড়ালেন না, হাসপাতালের দিকে রওনা হলেন।
মুনিরকে দেখে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। এ কী অবস্থা! এত দ্রুত এক জন মানুষের শরীর এত খারাপ হয় কীভাবে? জীবিত কোনো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।
মুনিরের বেডের পাশে এক জন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ইশারায় মিসির আলিকে কথা বলতে নিষেধ করলেন, বারান্দায় যেতে বললেন।
মিসির আলি বললেন, এই অবস্থা হল কীভাবে?
ডাক্তার সাহেব বললেন, বুঝতে পারছি না।
হয়েছেটা কী?
তাও তো জানা যাচ্ছে না। ড্রাগ এডিক্ট বলে গোড়ায় সন্দেহ হচ্ছিল, এখন তা মনে হচ্ছে না। ব্রেইনে কিছু বাড়তি ব্যাপার আছে। টিউমারজাতীয় কিছু হতে পারে।
বলেন কী?
নিউরোলজিস্ট সোবাহান সাহেব ভালো বলতে পারবেন। উনিই দেখছেন। আপনি বরং ওঁর সঙ্গে কথা বলুন।
উনি কি আছেন?
হ্যাঁ, আছেন।
সোবহান সাহেব বললেন, ওপেন না করে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে টিউমারের ব্যাপারটা হতে পারে। স্নায়ুর সঙ্গে মস্তিকের সংযোগের জায়গায় টিউমার ডেভেলপ করছে বলে মনে হচ্ছে সিমটম মিলে যাচ্ছে।
যদি টিউমার হয়, তাহলে কী হবে?
খুবই ফেটাল হবে। অবস্থা দ্রুত খারাপ হবে। হচ্ছেও তাই। পেশেন্টের হেলুসিনেশন হচ্ছে। বলল আমাকে-বাবা-মা এদের নাকি দেখতে পাচ্ছে। আপনি এই পেশেন্টের আত্মীয়স্বজনকে খবর দিন। আমার মনে হয় না, আমাদের খুব একটা কিছু করার আছে। একটা যা পারি সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। তার প্রয়োজন হচ্ছে না। রোগী ঘুমিয়েই কাটাচ্ছে। দিন-রাত ঘুমুচ্ছে এটাও এক দিক দিয়ে ভালো।
মিসির আলি রোগীর কাছে ফিরে এলেন। মুনিরের ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুনিরের ঘুম খুব প্রশান্ত নয় বলে তাঁর ধারণা হল। ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করছে। দ্রুত চোখের পাতা পড়ছে। REM (Rapid cyc movement)- তার মানে স্বপ্ন দেখছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে তার জগতে। কার সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে, সে কী বলছে কে জানে?
মুনির, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?
পারছি।
আমি কে বল তো?
আপনি মিসির আলি।
এই তো পারিছ-গুড বয়! তোমার যে এই অবস্থা, তা তো জানতাম না। আমি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
মুনির উঠে বসতে চেষ্টা করল। মিসির আলি তাকে আবার শুইয়ে দিলেন।
কী হয়েছে তোমায়?
মুনির ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল। জেনারেল ওয়ার্ডে অসংখ্য রোগী। এর মধ্যে এক জন মারা গেছে, তাকে ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড়। ফিনাইলের গন্ধ ছাড়িয়ে বিকট এক ধরনের গন্ধ আসছে, যে— গন্ধে সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে যায়। মিসির আলি বললেন, এখানে বেশি দিন থাকলে তো সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে।
মুনির চাপা গলায় বলল, বেশিক্ষণ তো এখানে থাকি না। অন্য জীবনগুলোতে ঘুরে বেড়াই। এখন আর আমার আসতে ইচ্ছে করে না। খুব কম আসি। এই যে এসেছি, আমার ভালো লাগছে না! চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এখানে যতক্ষণ থাকি প্ৰচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হয়।