ড্রাগস খায় কি না জানেন?
আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।
চোখের মণি খুব ছোট। আলো ফেললেও তেমন রেসপন্স করছে না। ড্রাগ এডিক্টদের এরকম হয়। ড্রাগস নেয় কি না আপনি জানেন না?
জ্বি-না।
মনে হচ্ছে নেয়। ড্রাগসটা অসম্ভব বেড়ে গেছে। এটা খুব অল্প দিনেই বিরাট সামাজিক সমস্যা হিসেবে আসবে। আপনি বরং একে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিন। দেরি করবেন না। হাসপাতালে চেনা-জানা কেউ আছে?
জ্বি-না।
হাসপাতালে ভর্তি করাটাও তো তাহলে এক সমস্যা হবে।
নিজাম সাহেব অসাধ্য সাধন করলেন। রাত নটার মধ্যে মুনিরকে হাসপাতালে তুর্তি করিয়ে ফেললেন। এক জন অল্পবয়স্ক ডাক্তারের হাত ধরে সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেললেন।
একটু দেখবেন ভাই। ছেলেটার কেউ নেই।
দেখব, নিশ্চয়ই দেখব।
খুবই দরিদ্র ছেলে।
ধনীর যে-চিকিৎসা হবে, দরিদ্রেরও সেই একই চিকিৎসা হবে।
ভাই, তা তো হয় না।
হয়। আপনারা জানেন না। আমরা ইন্টানি ডাক্তার হাসপাতাল আমরাই চালাই। ধনী-দরিদ্র নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। যখন বয়স্ক হব, প্রফেসর-ট্রফেসর হব, তখন হয়তো ঘামাব! এখনো আদর্শ বলে একটা ব্যাপার সামনে আছে।
নিজাম সাহেব ডাক্তার ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন।
বাড়ি ফিরতে-ফিরতে তাঁর এগারটা বেজে গেল। উদ্বিগ্ন মুখে বিনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তার বাবা কখনো এত দেরি করেন না! আজ কোন করছেন? অ্যাকসিডেন্ট হয়। নি তো? বারবার বিনুর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। বাবাকে দেখে সে সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেলল, কোথায় ছিলে তুমি?
মুনিরের খোঁজে গিয়েছিলাম।
আমি এদিকে ভয়ে অস্থির। ওঁকে পেয়েছিলে?
নিজাম সাহেব ইতস্তত করে বললেন, না।
বিনু দীর্ঘ সময় বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল, মিথ্যা কথা বলছ কেন বাবা?
নিজাম সাহেব মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
বাবা, উনি কি অসুস্থ?
হ্যাঁ।
কোথায় আছেন?
হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছি।
কী অসুখ?
বুঝতে পারছি না। কী সব আবোল-তাবোল কথা বলছে।
আমার এখানে যখন এসেছিলেন, তখনো আবোল-তাবোল কথা বলেছিলেন। আমি খুব রাগ করেছিলাম। i
নিজাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এখানে এসেছিল নাকি?
হ্যাঁ।
কই, তুই তো আমাকে বলিস নি?
উনি যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন, এটাও তো তুমি আমাকে বল নি।
নিজাম সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কী বলবেন, বুঝতে পারলেন না।
বাবা।
কি?
তুমি আমাকে একবার ওঁর কাছে নিয়ে যাবে?
নিজাম সাহেব চুপ করে রইলেন। বিনু বলল, আমি তাঁকে খুব কড়া-কড়া কথা বলেছি। আমার খারাপ লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে এস, ভাত দিচ্ছি।
নিজাম সাহেব ক্ষুধার্ত ছিলেন। কিন্তু কোনো খাবারই মুখে রুচল না। বারবার মনে হতে লাগল, বিনুর বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না তো? সে শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসবে না তো? গায়ে-হলুদের আর মাত্র পাঁচ দিন আছে। আত্মীয়স্বজনরা আসতে শুরু করবে। একটা কেলেঙ্কারি হবে না তো?
সারা রাত বিনু এক ফোঁটা ঘুমুতে পারল না। বারান্দায় মোড়া পেতে বসে রইল। তার কাছে সব কিছুই কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে একটা জটিল রহস্যের আবর্তে সে পড়ে গেছে, এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। বারান্দা অন্ধকার। অনেক দূরে একটা স্ট্রীটল্যাম্প জ্বলছে। তার আলো যেন চারপাশের অন্ধকারকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
একটি চিঠি এসেছে
মিসির আলির কাছে একটি চিঠি এসেছে।
এই কারণে তিনি অসম্ভব বিরক্ত। চিঠি না-খুলেই তিনি একপাশে ফেলে রেখেছেন। এখন বিরক্তি কমানের চেষ্টায় সুন্দর কিছু কল্পনা করার চেষ্টা করছেন। সুন্দর কোনো কল্পনাও মাথায় আসছে না।
তাঁর বিরক্তির মূল কারণ হচ্ছে, জটিল একটি বিষয় নিয়ে তিনি ভাবছিলেন। পিয়ন ঠিক এই সময় চিঠি নিয়ে এল। এবং এমনভাবে কড়া নাড়তে লাগল, যেন ভূমিকম্প হচ্ছে-এক্ষুণি সবাইকে ঘর থেকে বের করতে হবে। তিনি দরজা খুলে বললেন, কি ব্যাপার?
স্যার, একটি চিঠি।
রেজিস্ট্রি চিঠি?
জ্বি-না।
তাহলে এত হৈচৈ করছেন কেন? দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়।
মিসির আলি আবার তাঁর চিন্তায় ফিরে যেতে চেষ্টা করলেন। তিনি ভাবছিলেন, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়ে। ঈশ্বরের কল্পনাই তাঁর কাছে আপত্তিজনক মনে হয়, তবু তিনি ধরে নিলেন : এক জন ঈশ্বর আছেন-যিনি অসীমকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের মতো একটি ক্ষুদ্র প্রাণীও অসীমকে ধারণ করতে পারে। সে তা ধারণ করে মস্তিষ্কে। তার কল্পনা অসীম, তার চিন্তা অসীম।
ধর্মগ্রন্থগুলোও বারবার মানুষকে ঈশ্বর বলেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে– Then Moses said to God, if I come to thc people of Israci and say to thcm : The God has scnt me to you and they ask me, what is his name? What shall I say to them? God said to Moscs: I AM WHO AM. And hic said say : this to hic people of Israeli: I AM has sent me to you.
এই অংশটির মানে কি? মানে হচ্ছে ঈশ্বরের নাম হচ্ছে–আমি। ইসলাম ধর্মেও একই ব্যাপার। আল্লাহ্ বলেন-মানুষের মধ্যে তিনি নিজেকে ফুৎকার করেছেন। এক পয়গম্বরের কাহিনী আছে, যিনি ঘোষণা করলেন, আনাল হক-আমিই আল্লাহ। হিন্দু ধর্মে মানুষকে বলা হয়েছে।–নর-নারায়ণ।
মানুষ যদি ঈশ্বর হয়, তাহলে সর্বজগতের ওপর তার আধিপত্য থাকবে। মুনিরের কথাই ধরা যাক। তার কথামতো যদি অসংখ্য জীবন মানুষের থাকে এবং সে যদি ঈশ্বর হয়, তাহলে প্রতিটি জীবন সম্পর্কেই সে জানবে।