তুমি খুব ছোট জিনিস থেকে বড় সিদ্ধান্ত নিতে চাইছ। এটা ঠিক নয়।
ঠিক নয়?
না। ছবিটির আরো সহজ ব্যাখ্যা আছে। কোনো বিশেষ কারণে মহিলারা সেদিন ডান কাঁধে শাড়ির আঁচল দিয়েছিলেন। বাঁ কাঁধেই শাড়ির আঁচল রাখতে হবে, এ-রকম কোনো আইন তো জাতীয় পরিষদে পাস হয় নি।
তা হয় নি।
অন্য একটা ব্যাখ্যাও দেয়া যায়। এটা এটা সম্ভবত খুব সহজ কোনো ক্যামেরা-ট্রিক।
ট্রিকটা তারা করবে কেন?
তোমার মতো পাগলদের উসকে দেবার জন্যে। দেখি, আরেকটা সিগারেট দাও, তোমার সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলে আমিও পাগল হয়ে যাব। বিদেয় হও।
হচ্ছি।
শোন মিসির।
বল।
কাল-পরশু একবার এসো, তোমার থিওরিটা নিয়ে আলাপ করব।
আলাপ করবার মতো কিছু কি আছে?
না।
তা হলে আসতে বলছ কেন?
তোমার পাগলামি কথাবার্তা শুনতে ভালোই লাগে।
মিসির আলি বললেন, তুমি আমার এই প্রশ্নটির জবাব দাও। যদি তিনটি লোক একটি ছাগলকে দেখতে পায়, তাহলে কি তুমি স্বীকার করবে ছাগলটির একটি অস্তিত্ব আছে? সে রিয়েল?
হ্যাঁ, স্বীকার করব।
তিনটি মানুষ যদি একটি স্বপ্ন দেখে বা তিনটি মানুষ যদি একই চিন্তা করে, তাহলে সেই স্বপ্ন বা সেই চিন্তাকেও কি তুমি সত্য বলে স্বীকার করবো?
না। চিন্তা কোনো বাস্তব বিষয় নয়। এটা হচ্ছে মাথার মধ্যে কিছু বায়োকেমিক্যাল রিঅ্যাকশন। তুমি কাল এসো। কাল তোমার সঙ্গে আলাপ করব।
সপ্তাহখানিক পরে আসব। এই এক সপ্তাহ আমি পড়াশোনা করব। কোথাও বেরুব না। প্রচুর বইপত্র জোগাড় করেছি। কূর্ট গডেল-এর সেই থিওরি বোঝবার চেষ্টা করব।
ভালো কথা, পড়। তবে খেয়াল রাখবে, অল্পবিদ্যার অনেক সমস্যা নাপিত ফোঁড়া কাটতে পারে, সার্জেন চাকু হাতে নিতেও ভয় পায়।
চাকু হাতে নিতে হলে–তোমার কাছে আসব।
আরেকটা কথা-তোমার বিষয় সাইকোলজি, নিজেকে সেখানে আটকে রাখলে ভালো হয়। পদার্থবিদ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনাটা পদার্থবিদদের ওপর ছেড়ে দাও।
মিসির আলি কঠিন একটা উত্তর দিতে গিয়েও দিলেন না। অ্যাকাডেমিক মানুষরা একচক্ষু হরিণের মতো হন। নিজের বিষয় ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে পারেন না।
মুনির অফিসে আসছে না
মুনির গত তিন দিন ধরে অফিসে আসছে না। আজ এক তারিখ। বেতনের ডেট। যারা অসুস্থ, তারাও এই দিনে উপস্থিত থাকে—বেতন নিয়ে চলে যায়। মুনির আজও এল না।
নিজাম সাহেব সত্যি-সত্যি চিন্তিত বোধ করলেন। আজ অফিসে আসবার পথে বিনু বলেছে, বাবা, ওঁকে নিয়ে আসবে? মুনির সাহেবকে।
তিনি হাঁ-সূচক মাথা নেড়েছেন। বাসায় মুনিরকে আনার তাঁর কোনো ইচ্ছে নেই, কিন্তু খোঁজ নিশ্চয়ই নেয়া যেতে পারে এবং নেয়া উচিতও। ছেলেটিকে তিনি সত্যি-সত্যি পছন্দ করেন।
অফিস থেকে ঠিকানা নিয়ে, তিনি সন্ধ্যার আগে আগে মুনিরের ঘরের দরজায় উঁকি দিলেন।
তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। একটা মরা মানুষ যেন বিছানায় পড়ে আছে। বড়বড় করে শ্বাস নিচ্ছে।
তোমার কী হয়েছে?
শরীরটা খুব খারাপ। রাতে-দিনে কখনো ঘুমাতে পারি না। ক্রমাগত নানান জায়গায় যাই!
তোমার কথা বুঝলাম না। নানান জায়গায় যাও মানে? কোথায় যাও?
না, যাই না কোথাও। শুয়ে থাকি।
নিজাম সাহেব গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন। অনেক জ্বর।
ডাক্তার দেখিয়েছ?
জ্বি না। ডাক্তার কিছু করতে পারবে না।
কী করে বুঝলে ডাক্তার কিছু করতে পারবে না?
আমি জানি।
পাগলের মতো কথা বলবে না। তুমি সবজান্তা নাকি?
জ্বি, আমি সব কিছুই জানি।
নিজাম সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কী অদ্ভুত কথাবার্তা! সত্যি সত্যি কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে! গায়ে আধময়লা একটা কাঁথা। ঘরে আলো নেই। অল্প যা আলো আসছে, তাতে মুনিরের মুখ অস্বাভাবিক ফ্যাকাসে লাগছে। কিন্তু চোখ দুটি উজ্জ্বল চকচক করছে।
বিনু কেমন আছে?
ভালো আছে।
ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। নিজাম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই ছেলে এসব কী বলছে। বিনুকে তার দেখতে ইচ্ছে করবে কেন?
ও আমার সঙ্গে শুধু কষ্টই করেছে। বেশির ভাগ সময়ই ওকে আমি কষ্ট দিয়েছি। এতে আমার মন-খারাপ লাগে। আমি শুধু কাঁদি। ওকে আপনি বলবেন।
তুমি এসব কী বলছ?
জ্বি?
এসব কী কথাবার্তা তুমি বলছ?
আমার ভুল হয়েছে। আর বলব না।
তুমি এক দিন মাত্র গিয়েছ আমার বাসায়। বিনুর সঙ্গে তোমার কোনো পরিচয় থাকার কথা নয়।
জ্বি-না। আমার সব কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। জট পাকিয়ে গেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।
না না, ঠিক আছে! ডাক্তার দেখানো দরকার। অবহেলা করা ঠিক হবে না। চল আমার সঙ্গে।
কোথায়?
তোমাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
জ্বি আচ্ছা। বিনুকে আপনি কি দয়া করে একটা কথা বলতে পারবেন?
কী কথা?
বলবেন যে, তার ধারণা ঠিক নয়। আমি তার ওপর কোনো অবিচার করি নি।
আমি বলব। তুমি ঘুমাবার চেষ্টা কর।
জ্বি আচ্ছা।
মুনির সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর গাঢ় ঘুম। নিজাম সাহেব দীর্ঘ সময় তার পাশে রইলেন। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে এলেন। তারা এক জন ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে।–প্রেসার বেশি হই। কমপ্লিট রেস্ট নিতে হবে। নিজাম সাহেব এক জন ডাক্তার নিয়ে এলেন। সেই ডাক্তার অনেক ডাকাডাকি করেও মুনিরের ঘুম ভাঙাতে পারলেন না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করলে জ্বি বলে সাড়া দেয়, তারপর আর কোনো উত্তর করে না। ডাক্তার সাহেব বললেন, ইনি কি আপনার আত্মীয়?
জ্বি না। তবে আত্মীয়ের মতোই। ছেলেটিকে খুব স্নেহ করি। আমার অফিসেই কাজ করে।