হুঁ। পদার্থবিদ্যার একটি সূত্র হচ্ছে, একই সময়ে একই স্থানে দুটি বস্তু থাকবে না। কারণ বস্তু স্থান দখল করে। আর তুমি অসীম বস্তু নিয়ে এসেছ, সবাইকে ঠেসে ধরছে এক জায়গায়।
মাত্রা কিন্তু ভিন্ন। এক-এক জীবন এক-এক ডাইমেনশনে প্রবাহিত।
মূর্খরা যখন পদার্থবিদ্যা কিছু না-জেনে কথা বলে, তখন এ-রকম কথা বলে। ডাইমেনশনের তুমি জান কী?
খুবই কম জানি। এইটুকু জানি যে, বস্তুর তিনটি মাত্রা : দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা। সময়কে একটি মাত্রা ধরা হলে, হয় চারটি। এ ছাড়াও মাত্রা তিনের বেশি হয়। যেমন একটি বস্তুর কথা ধরা যাক, যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান—একটি পারফেক্ট কিউব। এর মাত্রা হচ্ছে তিন। তবে চতুর্মাত্রিক কিউবও আছে, যার নাম খুব সম্ভব টেস্যারেক্ট। চতুর্মাত্রিক কিউব আমরা আঁকতে পারি না, তবে তার প্রজেকশন বা ছায়ার মডেল তৈরি করা হয়েছে।
মন্দ না। কিছু-কিছু তো জান বলেই মনে হচ্ছে।
মিসির আলি বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমরা বিজ্ঞানীরা একটা সুপিরয়রিটি কমপ্লেক্সে সব সময় ভোগ। সব সময় মনে কর।–তোমরা ছাড়া অন্য কেউ বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে পারবে না।
রেগে যাচ্ছ কেন?
রাগছি না, বিরক্ত হচ্ছি! তোমাদের বিজ্ঞানে অসংখ্য গোঁজামিল। তোমরা তা ভালো করেই জান, অথচ ভান করা যে, এটা একটা নিখুঁত জিনিস।
গোঁজামিল তুমি কোথায় দেখলে?
থার্ড ডিনামিক্সের প্রথম সূত্রে তোমরা বল-শক্তি শূন্য থেকে সৃষ্টি করা যায় না, ধ্বংস করা যায় না। আবার এই তোমরাই বল সৃষ্ট আদিতে শূৰ্ণ থেকে শক্তির সৃষ্টি।
সৃষ্টির আদি অবস্থা ছিল ভিন্ন।
প্রাকৃতিক সূত্রগুলো তাহলে কি একেক অবস্থায় একেক রকম হবে? তোমরাই তো তা অস্বীকার কর! তোমরাই তো বল, প্রাকৃতিক সূত্রের কোনো পরিবর্তন হয় নি, হবে না।
দেওয়ান সাহেব গলার স্বর নরম করে বললেন, চা খাও।
তা খাব। তুমি আমার কথার জবাব দাও।
আছে। কিছু সমস্যা তো আছেই। প্রকৃতির ব্যাপারটায় রহস্য এত বেশি যে, কোনো থই পাওয়া যায় না। এবং সবচে বড় মুশকিল কি জোন? আমরা নিজেরাও এই প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির অংশ হয়ে সেই প্রকৃতিকে পুরোপুরি জানা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রকৃতির বাইরে যেতে হবে। তা যেহেতু পারছি না, প্রকৃতির অনেক রহস্যই বুঝতে পারছি না।
মিসির আলি বললেন, প্লটোর সেই বিখ্যাত গুহার উপমাটা কি তুমি জান?
প্লেটো পড়ার সময় কোথায়? ফিজিক্স নিয়েই কুল পাচ্ছি না।
মনে কল্প–একটা গুহায় কিছু লোককে সারা জীবন বন্দি করে রাখা হয়েছে। লোকগুলো গুহামুখের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসা বলে, গুহার বাইরে কী হচ্ছে জানে না। তাদের যে-ছায়া পড়ছে গুহার দেয়ালে, তা-ই শুধু তারা দেখছে। তার বাইরে এদের কোনো জগৎ নেই। ছায়াজগৎই তাদের কাছে একমাত্র সত্য। সত্যিকার জগৎ কী, এরা জানে না। আমাদের বেলাতেও তা-ই হতে পারে। আমরা যে-জগৎ দেখছি, এটা সম্ভবত ছায়াজগৎ। সত্যিকার জগৎ আছে আমাদের চোখের আড়ালে!
এ তো ফিলসফি-মায়াবাদ।
ফিলসফিতে অসুবিধা কোথায়?
দেওয়ান সাহেব বললেন, তুমি আমাকে কনফিউজ করে দিচ্ছ। দেখি, একটা সিগারেট দাও।
দেওয়ান সাহেব সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলেন। তাঁকে চিন্তিত মনে হল। মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, তোমাকে আরো কনফিউজ করে দিচ্ছি। তোমাদের দলের এক জন লোক বিখ্যাত পদার্থবিদ শ্রেডিনজার নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করেছিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রবক্তাদের এক জন।
ইরউইন শ্লোডিনজার?
হ্যাঁ। তিনি বলেছিলেন– My body functions as a pure mechanism according to laws of nature and I know by direct experience that I am dirccting the motions. It follows that I am the one who directs the atoms of he word in motions. Hence I am God Almighty.
এটা কি তোমার মুখস্থ ছিল?
না, ছিল না। তোমার কাছে আসার আগে মুখস্থ করেছি।
মনে হচ্ছে তৈরি হয়ে এসেছ।
হ্যাঁ। খুব ভালো। এখন বল আর কি বলবে?
তোমাকে একটা ছবি দেখাব। একটা বিয়ের ছবি। খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখবে। এবং ছবিটার মধ্যে কোনো বিশেষত্ব আছে কি না আমাকে বলবে।
দও তোমার ছবি।
মিসির আলি মুনির এবং বিনুর বিয়ের ছবিটি দিলেন। দেওয়ান সাহেব দীর্ঘ সময় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তেমন কিছু তো দেখছি না।
মেয়েটা শাড়ি কিভাবে পরেছে সেটা দেখেছ?
অন্য সবাই যেভাবে পরে, সেভাবেই পরেছে।
না, তা না। মেয়েরা শাড়ির আঁচল রাখে বাঁ কাঁধে। এই ছবিতে প্রতিটি মেয়ে শাড়ির আঁচল রেখেছে ডান কাঁধে। বয়স্ক মহিলারাও তাই করেছেন।
তাতে হয়েছেটা কী?
ছবিটা কোনো এক বিশেষ কারণে উলটো হয়ে গেছে। তোমার কি তা মনে হয় না?
হ্যাঁ, তা তো হয়েছেই। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক ছবি নয়।
মিসির আলি বললেন, নেচার পত্রিকায় একবার পড়েছিলাম, একটা ডান হাতের গ্লাভস যদি বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের বাইরে দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়, তবে সেই গ্লাভসটি হয়ে যাবে বাঁ হাতের গ্লাভস। আমি কি ঠিক বললাম?
পুরোপুরি ঠিক না-হলেও ঠিক। ডান হাতের গ্লাভস বাঁ হাতের গ্লাভস হবে। রাইট হ্যাণ্ডেড অবজেক্ট হবে লেফট হ্যাণ্ডেড অবজেক্ট।
এই ছবির মধ্যেও কি তাই হয় নি?
দেওয়ান সাহেব। আবার ছবিটি হাতে নিলেন। মিসির আলি বললেন, ছবিটি এসেছে অন্য মাত্রার এক জীবন থেকে। এই জন্যে ছবির এই পরিবর্তন।