প্রকৃতির একটি স্বার্থের কথা আমরা কল্পনা করতে পারি, সেটি হচ্ছে।–কৌতূহলের সঙ্গে সে একটি পরীক্ষা চালাচ্ছে। তার চোখের সামনে মানবজীবনের, সেই সঙ্গে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডেরও, অসংখ্য ভেরিয়েশন। প্রতিটিই চলছে স্বাধীনভাবে, একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো যোগ নেই, কারণ প্রতিটিই প্রবাহিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়।
প্রকৃতি না বলে ঈশ্বরী শব্দটি ব্যবহার করলে ব্যাপারটা আরো সহজ হয়। ঈশ্বর নামের কোনো মহাশক্তিধর, যিনি অসীমকে ধারণ করতে পারেন, কারণ তিনি নিজেই অসীম-সেই তিনিই অসীম নিয়ে খেলছেন।
কাজেই আমরা দেখছি মুনির নামের ছেলেটির অসংখ্য জীবন। এক জীবনে সে বিনুকে বিয়ে করে, অন্য জীবনে বিনুকে বিয়ে করতে পারে না। এক জীবনে তার এবং বিনুর একটি ছেলে হয়, ছেলেটি চার বছর বয়সে মারা যায়। অন্য জীবনে ছেলেটি বেঁচে থাকে। কত বিচিত্র রকমের পরিবর্তন। এবং প্রতিটি পরিবর্তনকেই প্রকৃতি গভীর আগ্রহে এবং গভীর মমতায় দেখছে।
প্রকৃতির নিয়ম কঠিন এবং ব্যতিক্রমহীন, তবু মাঝে-মাঝে হয়তো কিছু-একটা হয়। সামান্য এদিক-ওদিক হয়। জীবনের এক ধারায় মানুষ প্রকৃতিরই কোনো- এক বিচিত্র কারণে অন্য ধারায় এসে হকচকিয়ে যায়।
এ-রকম ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এই মুহূর্তে আমি একটি উদাহরণ দিতে পারি। খুঁজলে নিশ্চয়ই আরো প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে।
উদাহরণটি আমেরিকার আরিজোনা শহরের। আঠার শ চরিশ সালের ঘটনা। ঘটনাটি স্থানীয় মেথডিস্ট চার্চের নথিতে অন্তর্ভুক্ত। বেশ কিছু অনুসন্ধানী দল ঘটনাটি বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা অতীতে করেছে। এই ঘটনা বিশ্বে সংঘটিত অদ্ভুত ঘটনাগুলোর একটি বলে এখনো মনে করা হয়।
ডেভিড় ল্যাংম্যান আরিজোনা শহরের এক জন সাধারণ ছুতোর মিস্ত্রী। ছুতোরের কাজ করে জীবনধারণ করেন। সরল সাধাসিধে মানুষ। তবে অতিরিক্ত মদ্যপানের বদ অত্যাস ছিল। মাঝে-মাঝে পুরো মাতাল হয়ে ঘরে ফিরতেন। স্ত্রী এবং পুত্ৰ-কন্যাদের ওপর অত্যাচার করতেন। নেশা কেটে গেলেই আবার ভালোমানুষ।
ভদ্রলোক চল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। যথারীতি তাঁকে কফিনে ঢুকিয়ে গোর দেওয়া হয়। এর প্রায় চার বছর পরের ঘটনা। এক রাতে প্রবল তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটুউঁচু বরফ। দেখা গেল, এই বরফ ভেঙে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত ডেভিড ল্যাং আসছেন। প্রথমে সবাই ভাবল চোখের ভুল। পরে দেখা গেল-না, চোখের ভুল নয়, আসলেই ডেভিড ল্যাংম্যান। সেই মানুষ, সেই আচার-আচরণ। বী হাতের একটি আঙুল নেই। কপালে গভীর ক্ষতচিহ্ন, তাঁর চোখের দৃষ্টিতে দিশেহারা ভাব। লোকজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
তিনি বললেন, আমি ডেভিড ল্যাংম্যান।
তুমি কোথেকে এসেছ?
আসব। আবার কোথা থেকে। আমি তো এখানেই ছিলাম। আমি আমার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।
তোমার ছেলেমেয়েদের নাম কি?
তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের নাম বললেন। কাউন্টির শেরিফ তাঁকে গ্রেফতার করে হাজতখানায় রেখে দিল। খবর পেয়ে ডেভিড় ল্যাংম্যানের স্ত্রী এল দেখতে। বিস্ময়ে তার বাকরোধ হল! ডেভিড ল্যাংম্যান বললেন, আমার কী হয়েছে বল তো, সব কেমন অচেনা লাগছে। এরা আমাকে হাজতে আটকে রেখেছে?
তুমি মারা যাও নি?
আমি মারা যাব কোন! এ-সব কী বলছি?
তুমি তো মারা গেছ। চার্চ ইয়ার্ডে তোমাকে গোর দেয়া হয়েছে।
ডেভিড ল্যাংম্যানের স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ডেভিড ল্যাংম্যানকে তাঁর স্ত্রী-পুত্ররা কেউ গ্রহণ করল না। শহরের সবাই তাঁকে বর্জন করল। তিনি একা একা থাকতেন। রাতে চার্চে ঘুমাতেন। শেষের দিকে তাঁর মাথারও গণ্ডগোল হল। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বলতেন, আমার কী হয়েছে? আমার কী হয়েছে? তাঁর এই কষ্টের জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। দু বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর ডেভিড ল্যাংম্যান নামেই তাঁর কবর হয়।
ঘটনাটি অবিশ্বাস্য! কোনো রকম ব্যাখ্যা এর জন্যে দেয়া যায় না। এ-জাতীয় অবিশ্বাস্য ঘটনার নজির প্রাচীন উপকথায় প্রচুর আছে। উত্তর ভারতের উপকথায় মহারাজ উরুনির কথা আছে, যাঁকে বলা হয়েছে দানসাগর। মহারাজ উন্ননি শিকার করতে গিয়ে, গণ্ডারের শিংয়ের আঘাতে নিহত হন। রাজকীয় মর্যাদায় তাঁর দাহ সম্পন্ন করার পরপরই তিনি আবার বন থেকে ফিরে আসেন এবং রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। তবে তাঁর চরিত্রের বিরাট পরিবর্তন হয়। তিনি ধর্মকর্ম দানাধ্যানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাজতাণ্ডার দেখতে-দেখতে শূন্য হয়ে যায়।
এইজাতীয় রহস্যকে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রবণতা আমাদের মধ্যে আছে। আমরা ভান করি যে, এ-সব কখনো ঘটে নি। তা না-করে এই ধরনের ঘটনাগুলো নিয়ে ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। যাতে প্রকৃতির বিপুল রহস্যের কিছু জট আমরা খোলার চেষ্টা করতে পারি।
মিসির আলি তাঁর এই লেখাটি পড়তে দিলেন তাঁর বন্ধু দেওয়ান সাহেবকে। দেওয়ান সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। পুরোপর অ্যাকাডেমিক মানুষ। পদার্থবিদ্যার সূত্রের মধ্যে যা পড়ে না, তা তিনি চোখ বন্ধ করে ঝুড়িতে ফেলে দেন।
দেওয়ান সাহেব মিসির আলির লেখা পড়ে গম্ভীর মুখে বললেন, তুমি বদ্ধ উন্মাদ।
তোমার তাই ধারণা?
ধারণা অন্য রকম ছিল। লেখা পড়ে ধারণা পাল্টেছে। তুমি এক কাজ কর। ভালো এক জন ডাক্তারকে বল তোমার চিকিৎসা করতে।
আমার এই লেখাটাকে তোমার পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে?