চা খাবেন, না লেবু দিয়ে দিয়ে সরবত বানিয়ে দেব? আপনি খুব ক্লান্ত, সেই জন্যে বলছি।
না, কিছু লাগবে না।
বিনু ভেতরে চলে গেল। আবার ফিরে এল লেবুর সরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে।
আমাদের তো ফ্ৰীজ নেই, এই জন্যে খুব ঠাণ্ডা হবে না। গরম সরবত।
মুনির হেসে ফেলল। বিনু বলল, আমার মনে হয়, আপনি আমাকে কিছু বলতে এসেছেন। বলে ফেলুন।
না, এমনি এসেছি।
আপনি এমনি আসেন নি। কি বলতে চান। আপনি বলুন। আমি রাগ করব না।
মুনির ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি আপনাকে চিনি।
তা তো চিনবেনই। না-চেনার তো কথা না। আগে একদিন এসেছিলেন। আমার বাবাকে এত ভালো করে চেনেন, আর আমাকে চিনবেন না?
তার চেয়েও ভালোভাবে চিনি।
তাই নাকি?
জ্বি।
কীভাবে বলুন তো?
আপনি যখন খুব ছোট, তখন কী কী করতেন সব আমি বলতে পারব।
বেশ তো, দু-একটা বলুন, আমি শুনি।
আমি মীনার কথা জানি। মীনা আপনার খুব বন্ধু ছিল না?
কে বলেছে আপনাকে মীনার কথা?
মুনির চুপ করে রইল।
বলুন, কে মীনার কথা আপনাকে বলেছে?
মুনির একবার ভাবল বলে ফেলে–বিনু, ও সব কথা আমি তোমার কাছ থেকেই শুনেছি। এক সময় তুমিই আমাকে বলেছ। বিয়ের পর রাত জেগে তুমি কত গল্প করতে! কিন্তু এই মেয়েটিকে এ-সব বলা অর্থহীন। সে কিছুই বুঝবে না।
কি ব্যাপার, চুপ করে আছেন?
মুনির নিচু স্বরে বলল, আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো আমাকে দেখে কি আপনার খুব চেনা-চেনা মনে হয় নি?
না। চেনা-চেনা মনে হবে কেন? চেনা মনে হবার কি কোনো কারণ আছে?
জ্বি-না। আচ্ছা, আমি উঠি।
মুনির উঠে দাঁড়াল। বিনু বলল, আপনি আর এ-রকম এক-একা এ বাড়িতে আসবেন না!
জ্বি আচ্ছা।
যদি কখনো আসতে চান, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন।
ভয় নেই, আমি আর আসব না।
আপনি আপনার এক বন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে। এ-সব করবেন না। বাবা আপনাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। আপনার কাণ্ডকারখানা শুনলে বাবা মনে খুব কষ্ট পাবেন! আমি নিজে বাবাকে এ—সব কখনো বলব না। আপনিও বলবেন না।
মুনির হেসে ফেলল। হঠাৎ তার হাসি এসে গেল, কারণ বিনূর ভঙ্গিটা তার খুব চেনা। রাগী-রাগী গলায় অনেকক্ষণ কথা বলবার পর, হঠাৎ তার রাগ পড়ে যায়। চোখে পানি এসে যায়। এখনো বিনুর চোখে পানি আসছে। আসতেই হবে।
আপনি হাসছেন কেন?
হাসছি, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে এত সব কঠিন কথা বলার জন্যে আপনার খুব কষ্ট হবে। আপনি কাঁদতে শুরু করবেন।
আপনি বেরিয়ে যান।
মুনির বের হয়ে এল। বিনু সত্যি-সত্যি কাঁদতে বসল। তার খুব খারাপ লাগছে।
মিসির আলি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছেন
মিসির আলি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি গত কয়েক দিন ধরেই চেষ্টা করছেন তাঁর সেই থিওরি গুছিয়ে ফেলতে পারছেন না। লিখতে গিয়ে সব আরো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে মনে মনে যা ভাবছেন, তা লিখতে পারছেন না। সারা দুপুর বসে বসে তিনি তাঁর থিওরির পয়েন্টগুলো লিখলেন। সেগুলো কেটে ফেলে আবার লিখলেন। সন্ধ্যাবেলা সব কাগজপত্র ফেলে দিয়ে নতুন খাতা কিনে আনলেন। কলম কিনলেন। তিনি লক্ষ করেছেন, খাতা-কলম বদলে ফেললে মাঝে-মাঝে তারতর করে লেখা এগোয়। তাই হল। রাতের বেলা বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা লিখে ফেললেন। রচনার নাম দিলেন—
একজীবন : বহুজীবন
একটি মানুষের কয়েকটি জীবন থাকে? তাই তো মনে হয়। এক জন শিশু জন্মায়, বড় হয়, মৃত্যু হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনকাল একটি ধারায় প্রবাহিত হয়। সেই ধারায় সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার নানান ঘটনা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জীবনের ধারা একটি না হয়ে কি অনেকগুলো হতে পারে না? ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। মনে করি, মুনির নামের একটি ছেলে বড় হচ্ছে শৈশবে তার পিতৃবিয়োগ হল। সেই মুহূর্ত থেকে যদি তাঁর জীবন দুটি ভাগে ভাগ হয়, তাহলে কেমন হয়? একটি ভাগে ছেলেটির পিতৃবিয়োগ হল, অন্য ভাগে হল না।–বাবা বেঁচেই রইলেন। দুটি জীবনই সমানে প্রবাহিত হতে লাগল। তবু এক জীবনের সঙ্গে অন্য জীবনের কোনো যোগ রইল না। কারণ এই দুটি জগতের মাত্রা ভিন্ন।
দুই ভিন্ন মাত্রায় দুটি জীবন প্রবাহিত হচ্ছে। এক জীবনে ছেলেটি সুখী-অন্য জীবনে নয়।
এখন এই দুটি জীবনের ব্যাপারটাকে আরো বিস্তৃত করা যাক। ধরা যাক, জীবন দুটি নয়। অসংখ্য, সীমাহীন। প্রকৃতি একটি মানুষের জীবনে যতগুলো ভেরিয়েশন হওয়া সম্ভব, সবগুলোই পরীক্ষা করে দেখছে। সবই সে চালু করেছে।
অসীম ব্যাপারটা এমনই যে, এ-পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্যেই অসীম সংখ্যক জীবনধারা চালু করতে পারে। কারণ অসীম সংখ্যাটির এমনই মাহাত্ম্য যে, সে অসীমসংখ্যক অসীমকেও ধারণ করতে পারে। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট অসীমের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর হিলবার্ট হোটেলের সমস্যায়। এই হোটেলটির সবচে বড়ো গুণ হচ্ছে, হোটেলের প্রতিটি কক্ষ অতিথি দিয়ে পূর্ণ হবার পরও যত খুশি অতিথিকে ঢোকান যায়। এর জন্যে পুরনো অতিথিদের কোনো অসুবিধে হয় না। কারো কক্ষে দু জন অতিথি ঢোকানোর প্রয়োজন হয় না। এটা সম্ভব হয় অসীম সংখ্যাটির অদ্ভুত গুণাবলীর জন্যে। মানুষ তার প্রচুর জ্ঞান সত্ত্বেও অসীমকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। সবচে সহজ ব্যাখ্যাটি হচ্ছে–অসীম হচ্ছে বিরাট বই, যার শুরুর পাতা এবং শেষের পাতা বলে কিছু নেই।
এখন কথা হচ্ছে, কেন একটি মানুষের জন্যে অসংখ্য জীবনের ব্যবস্থা করবে? প্রকৃতির স্বার্থ কী?