আজ এর বেশি কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। এখন তৈরি হব ভ্রমণের জন্যে। অদ্ভুত এক ভ্রমণ। এই জীবন ছেড়ে অন্য এক জীবনে।
মুনির খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। বাতি নিভিয়ে সিগারেট ধরাল। মনে-মনে বলল-ভ্রমণের প্রস্তুতি। যাত্রা হবে শুরু। এ-রকম যদি হত-ওয়ান ওয়ে জানি, আর ফিরে আসতে হবে না।–তাহলে কেমন হত? স্বপ্ন—জীবনটি কি খুবই সুখের? মৃত্যু ঐ জীবনেও হানা দিয়েছে। টগরের মৃত্যু হল। বাবা-মোর কাছে কত তীব্রই না ছিল সেই শোক! সে এখন বুঝতে পারছে না, কিন্তু ঐ জীবনের মুনির কী গভীর শোক পেয়েছে, তা সে রক্তের মধ্যে অনুভব করে। শোক এবং শোক, চারদিকেই শোক। জাপানি একটি কবিতায় আছে না?
বল দেখি কোথা যাই
কোথা গেলে শান্তি পাই?
ভাবছিলাম বনে যাব
তাপিত হিয়া জুড়াব
সেখানেও অর্ধ-রাত্রে
কাঁদে মৃগী কম্প গাত্রে।
মুনির সিগারেট ফেলে নিজেকে তৈরি করল। মুহূর্তে ঘরের চেহারা পাল্টে গেল। সে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়, তারা কোথায় যেন বেরুচ্ছে। ঐ তো বিনু)। আশ্চৰ্য, কী সুন্দর লাগছে বিনুকে। অসম্ভব সুন্দরা বিনুর চুলগুলো পিঠময় ছড়ান। এ-রকম খোলা চুলে সে কোথায় যাচ্ছে নাকি বিনুযাচ্ছে না, সে একাই যাচ্ছে? একটি কাজের লোক বড়-বড় দুটি সুটকেস নিয়ে নামছে। তারা নিশ্চয়ই দূরে কোথাও যাচ্ছে। ঘরে দিনের আলো। কটা বাজছে কে জানে। মুনির হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল।–দশটা পনের। ঘড়ির ডায়াল সবুজ রঙের। বাহ্, ইন্টারেষ্টিং তো! এটা তো স্বপ্ন! স্বপ্নে তো রঙ দেখার কথা নয়। সে রঙ দেখছে কেন? কে বলেছিল, স্বপ্নে রঙ দেখার কথা নয়? মনে পড়ছে না। নামটা মনে পড়ছে না। মা দিয়ে শুরু। মিহির? মুনির? না না, মিসির। মিসির আলি। মিসির আলি বলেছেন।–দ্রমণের সময় খবরের কাগজ হাতে নেবে। খবরের কাগজ হাতে নিতে হবে কেন? মিসির আলি বলেছেন, একটা খবরের কাগজ হাতে নেবে। কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। কেন বললেন এ-রকম কথা। বিনু কেমন যেন বিরক্ত মুখে তাকাচ্ছে।
টগর। টগর।
মুনির চমকে উঠল। টগরকে কেন ডাকছে? টগর চার বছর বয়সে মারা গেল না? বিন্দু কি ভুলে গেছে? এত বড় একটা ঘটনা কি ভোলার কথা অবশ্যি ভোলাটা অস্বাভাবিকও নয়। এই তো সে নিজেই অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছে। কি কি যেন তাকে বলেছিলেন মিসির আলি। এখন আর কিছুই মনে পড়ছে না।
টগর। আমি কিন্তু খুব রাগ করছি। আর এক বার মাত্র ডাকব। এর মধ্যে ভূমি যদি আসি ভালো কথা, না এলে তোমাকে ছাড়াই রওনা হব।
মুনির অবাক হয়ে দেখল, টগর এসেছে। আট-ন বছর বয়সের চশমাপরা একটা ছেলে। টগর বলল, আমি যাব না, মা।
বিনু বলল, খুব ভালো কথা, থাক তুমি।
বিনু তরতর করে নেমে যাচ্ছে। টগর হাসিমুখে মুনিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার মানে কি টগর বেঁচে আছে? চার বছর বয়সে ও তাহলে মারা যায় নি? এটা কোন জীবন? অন্য আরেকটা? এর মানে কী?
মুনিরের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গে ঘোর কেটে গেল। সে আছে তার পরিচিত জায়গায়। ভ্ৰমণ শেষ হয়েছে।
মুনির বাতি জ্বালোল। খাতা খুলে লিখল, মানুষের জীবন দুটি নয়। অনেক। হয়তো-বা অসংখ্য।
ক্লান্তিতে খাতার ওপরই মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল। সারারাত সেই ঘুম ভাঙল না। কত বিচিত্র স্বপ্ন দেখল ঘুমিয়ে-ঘূমিয়ে। কখনো মনে হচ্ছে সে মেঘে-মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে, আবার কখনো-বা তলিয়ে যাচ্ছে গভীর অতলে। কী গাঢ় নীল সেই পানি। চারদিকে শব্দহীন সময়। কী অসহ্য নীরব। এই নীরবতার মধ্যেও কে যেন নিচু গলায় তাকে ডাকছে। বিনু ডাকছে নাকি? এটা কি বিনুর গলা? আহু! কী সুন্দর করেই না সে ডাকছে! আবার সব চুপচাপ। অসহ্য নীরবতা। মুনির স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদছে। চেঁচিয়েচেঁচিয়ে বলছে-আমাকে মুক্তি দাও। কিন্তু তার চিৎকারেও কোনো শব্দ হচ্ছে না। কী অদ্ভুত অবস্থা!
তার ঘুম ভাঙল ভোরবেলা। প্রথম খানিকক্ষণ বুঝতেই পারল না, সে কোথায় আছে। কোন জগতে! সে ঠিক করল, আজ অফিসে যাবে না। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবে। দুপুরবেলার দিকে যাবে মিসির আলির কাছে। এমনি খানিকক্ষণ গল্প করবে। দুপুরবেলা বা দিনের আলোয় তাঁর কাছে কখনো যাওয়া হয় নি। দিনের আলোয় লোকটিকে দেখতে কেমন দেখায় কে জানে। তবে দুপুরবেলা ওকে হয়তো পাওয়া যাবে না। ক্লাসে থাকবেন কিংবা লাইব্রেরিতে থাকবেন।
মিসির আলি ঘরেই ছিলেন, অবাক হয়ে বললেন, অসময়ে তুমি, ব্যাপার কি বল তো? অফিসে যাও নি?
জ্বি-না। আপনি ইউনিভার্সিটিতে যান নি?
না। আজ বৃহস্পতিবার না? বৃহস্পতিবারে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকে।
কী করছেন স্যার?
রান্না করছি। রোজ-রোজ হোটেলে খাওয়া ভালো লাগে না।
কী রান্না করছেন?
নতুন ধরনের রান্না, আমিই তার আবিষ্কারক। নাম হচ্ছে মিসির মিকচার। চাল, ডাল এবং আলু একসঙ্গে মিশিয়ে দু চামচ ভিনিগার, এক চামচ সয়া সস, একটুখানি লবণ, দুটো কাঁচা লঙ্কা এবং আধা চামচ সরিষা বাটা দিয়ে সেদ্ধ করতে হয়। সেদ্ধ হয়ে যাবার পুর এক চামচ বাটারওয়েল দিয়ে দমে দিতে হয়-অপূর্ব একটা জিনিস নামে। খেয়ে দেখ।
জিনিস যেটা নামল, তার চেহারা দেখলে খেতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু স্বাদ সত্যি চমৎকার। মুনির অবাক হয়ে গেল।
কি, কেমন লাগছে?
জ্বি স্যার, ভালো।
আরো কিছু বিশেষণ দিয়ে বল। শুধু ভালো, এর বেশি কিছু না?
চমৎকার স্যারা
এখন বল, তুমি যে ভ্রমণে যাচ্ছ, সেখানে কখনো খাওয়াদাওয়া করেছ? চট করে বলতে হবে, না-ভেবে বল!