চল, রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটি।
চলুন।
তারা দু জন উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত হেঁটে বেড়াল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। মিসির আলির মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। একসময় তিনি বললেন, তুমি কি এর পরেও নিজাম সাহেবের বাসায় গিয়েছিলে?
জ্বি-না স্যার।
চল, আজ যাওয়া যাক।
কেন?
এমনি যাব। দেখব। কথা বলব। ভয় নেই, ছবির কথা কিছু বলব না।
আমার স্যার যেতে ইচ্ছে করছে না।
বেশ, তুমি না গেলো। কীভাবে যেতে হয় আমাকে বল। আমি একাই যাব।
স্যার, আমি চাই না ঐ মেয়েটি ছবি সম্পর্কে কিছু জানুক।
ও কিচ্ছুই জানবে না।
মুনির খুব অনিচ্ছার সঙ্গে ঠিকানা বলল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
স্যার, যাই?
আচ্ছা, দেখা হবে।
মুনির ঘর থেকে বের হয়েও বেশ কিছু সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল, যেন চলে যাবার ব্যাপারটায় তার মন ঠিক সায় দিচ্ছে না, আবার না-যাওয়াটাও মনঃপূত নয়।
মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন-মনে-মনে বললেন, অদ্ভুত মানবজীবন। মানুষকে আমৃত্যু দ্বিধা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে বাস করতে হয়।
তিনি নিজেও তাঁর জীবন দ্বিধার মধ্যে পার করে দিচ্ছেন। সমাজ-সংসার থেকে আলাদা হয়ে বাস করতে তাঁর ভালো লাগে, আবার লাগে না। মানুষের মঙ্গলের জন্যে তীব্র বাসনা অনুভব করেন। এক জন মমতাময়ী স্ত্রী, কয়েকটি হাসিখুশি শিশুর মাঝখানে নিজেকে কল্পনা করতে ভালো লাগে! আবার পর মুহূর্তেই মনে হয়–এই তো বেশ আছি। বন্ধনহীন মুক্ত জীবনের মতো আনন্দের আর কী হতে পারে? পুরোপুরি নিঃসঙ্গও তো নন। তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরির দিকে তাকালে মন অন্য রকম হয়ে যায়। সারি—সারি বই। কত বিচিত্ৰ চিন্তা, কত বিচিত্র কল্পনার কী অপূর্ব সমাবেশ। এদের মাঝখানে থেকে নিঃসঙ্গ হবার কোনো উপায় নেই।
মিসির আলি বইয়ের তাকের দিকে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালেন। যে-বই হাতে উঠে আসে, সে বইটিই খানিকক্ষণ পড়বেন। এটা তাঁর এক ধরনের খেলা। সব সময়ই এমন একটা বই উঠে আসে, যা পড়তে ইচ্ছে করে না। আবার পড়তে শুরু করলে ভালো লাগে।
আজও তাই হল। কবিতার বই হাতে। এই একটি বিষয়ে পড়াশোনা তাঁর ভালো লাগে না। কবিতার বই সজ্ঞানে কখনো কেনেন নি, এখানে যা আছে সবই নীলুনামের তাঁর এক ছাত্রীর দেয়া উপহার। মেয়েদের এই এক অদ্ভুত সাইকোলজি, উপহার দেবার বেলায় কবিতার বই খোঁজে।
মিসির আলি বইটির পাতা ওন্টাতে লাগলেন। ইংরেজি কবিতা। কার লেখা কে জানে? অবশ্য নামে কিছু যায়-আসে না। তিনি ভ্রূ কুঁচকে কয়েক লাইন পড়তে চেষ্টা করলেন–
I can not see what flowers are at my seet,
Nor what soft incense hangs upon the boughs,
এর কোনো মানে হয়!
কোনো মানে হয় না, তবু পড়তে এত ভালো লাগে! মিসির আলি পড়তে শুরু করলেন।
কে যেন কড়া নাড়ছে
অনেকক্ষণ ধরে কে যেন কড়া নাড়ছে।
কড়া নাড়ার ধরনটা অদ্ভুত। দুটি টোকা দিয়ে থেমে যাচ্ছে, আবার দুটি টোকা দিচ্ছে। জানালার পর্দা সরিয়ে বিনু উঁকি দিল। অপরিচিত এক জন মানুষ। রোগা, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। এর মাঝে দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে।
বিনু ভয় পাওয়া গলায় বলল, কে?
লোকটি খুবই কোমল স্বরে কল, আমাকে তুমি চিলবে না। আমার নাম মিসির আলি।
কোমল স্বর খুবই সন্দেহজনক। এ-রকম মিষ্টি গলায় একটা অপরিচিত লোক কথা বলবে কেন?
বিনু বলল, বাবা তো একটু বাজার করতে গিয়েছে। আপনি আধা ঘন্টা পরে আসুন না।
বাসায় বুঝি তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।
জ্বি-না।
আচ্ছা ঠিক আছে, দরজা খুলতে হবে না। আমি এখানেই আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করি।
বিনু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। মিসির আলি বললেন, একটা কাজ কর, জানালা দিয়ে আমাকে একটা দেশলাই দাও।
আসুন, আপনি ভেতরে এসে বসুন।
মিসির আলি হেসে বললেন, এখন বুঝি আমাকে আর দুষ্ট লোক মনে হচ্ছে না?
না।
নৌকায় যখন ডাকাতি হয়, তখন ডাকাতরা কী করে, জান? আগুন চায়।
এটা তো আর নৌকা না।
মিসির আলি হেসে ফেললেন। মুনির যা বলেছে, তাই–এ মেয়েটির আচারআচরণে খুব স্বাভাবিক একটি ভঙ্গি আছে। ঠিক সুন্দরী তাকে বলা যাবে না, তবে চেহারা খুব মায়াকাড়া। তার চেয়েও বড় কথা, ছবিতে এই মেয়েটিই কনে হয়ে বসে আছে। এই মেয়েটির বা গালের কাটা দাগটাও ছবিতে নিখুঁত এসেছে।
বিনু, তুমি বস, তোমার সঙ্গে গল্প করি।
আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?
মুনির বলেছে। মুনিরকে চেন তো? তোমার আব্বার সঙ্গে কাজ করে।
খুব ভালো করে চিনি। আপনি কি ওঁর আত্মীয়?
ঠিক আত্মীয় না হলেও খুব চেনা! মাঝে মাঝে অনান্তীয় লোকজনকেও খুব চেনা মনে হয় না? মুনিরও সে-রকম।
আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলেন।
তুমিও খুব সুন্দর করে কথা বল।
বাবার কাছে কী জন্যে এসেছেন?
ঠিক তোমার বাবার কাছে আমি আসি নি। আমি এসেছি তোমার কাছে।
বিনু বিস্মিত হয়ে তাকাল। মিসির আলি একটা ছবির উল্টো পিঠ দেখিয়ে বললেন, এখানে লেখা আছে, আমাদের টগরমনি। বয়স এক বছর। এই হাতের লেখাটা কি তোমার?
বিনু খুবই অবাক হয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল।
বল, তোমার হাতের লেখা?
জ্বি। কিন্তু আমি এ-রকম কিছু কখনো লিখি নি।
ছবিটা দেখি।
উঁহু, ছবিটা এখন দেখাব না। পরে দেখাব। এখন অন্য একটা ছবি দেখ, বিয়ের ছবি। বর-কনে বসে আছে। তাদের ঘিরে আত্মীয়স্বজনরা দাঁড়িয়ে আছে। বর এবং কনের ছবি আমি কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখব। তুমি শুধু অন্যদের ছবিগুলো দেখবে এবং বলবে এদের চেন কি না।