মিসির আলির সে-রাতে ভালো ঘুম হল না। ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখে রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেল। বাকিরাতটা জেগে কাটাতে হল। স্বপ্নৰ্দশ্য নিয়েও প্রচুর চিন্তা করলেন। অবদমিত কামনাই স্বপ্নে উপস্থিত হয়।। ব্যাখ্যা সহজ এবং চমৎকার, কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা ফাঁকি আছে। কিছু-একটা বাকি থেকে যায়। সেই কিছুর রহস্য কি কোনো দিন ভেদ হবে?
আচ্ছা, পশু-পাখি। এরাও কি স্বপ্ন দেখে? অবদমিত কামনা কি তাদের নেই? পশুদের স্বপ্ন কেমন হয়? স্বপ্ন দেখার সময় মানুষের চোখের পাতা কাঁপতে থাকে—বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাকে বলে Rapid eye movement (REM), ঐ জাতীয় কম্পন তিনি একটি ঘুমন্ত কুকুরের চোখের পাতায় দেখেছিলেন। সেই কুকুরটি কি তখন স্বপ্ন দেখছিল? জানার কোনো উপায় নেই।
মিসির আলির খানিকটা মন খারাপ হল। এক দিন না এক দিন। এইসব রহস্যের সমাধান হবে, কিন্তু তিনি জেনে যেতে পারবেন না। মানুষ স্বল্পায়ু প্রাণী—এটাও একটা গভীর বেদনার ব্যাপার। এত বুদ্ধি নিয়ে সৌরজগতে যে-প্ৰাণীটি এসেছে, তার কর্মকাল সীমাবদ্ধ।
তিনি বাতি নিভিয়ে ঘুমের চেষ্টা করছেন-লাভ হচ্ছে না। বিচিত্র সব চিন্তা মাথায় আসছে। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। আবার মিল আছেও। অদৃশ্য যে সুতোয় মিলগুলো গাঁথা, সে-সুতোটির নাম অনন্ত মহাকাল–The eternity.
নিউরোলজিস্ট প্রফেসর আসগর
নিউরোলজিস্ট প্রফেসর আসগর বিশালদেহী মানুষ। গোলগোল মুখ। মাথাভর্তি টাক–তীক্ষ্ণ চোখ। শিশুরা ভয় পেয়ে যাবার মতো চেহারা, কিন্তু মানুষটি হাসিখুশি। কারণে অকারণে রোগীকে ধমক দেয়ার বাজে অভ্যাসটি এখনো অর্জন করেন নি।
ভদ্রলোক অনেক ঝামেলা করলেন। প্রথম বারের স্ক্যানিং ভালো হয় নি, দ্বিতীয় বার করলেন। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলেন না। চোখে পড়ার মতো কোনো অস্বাভাবিকতা ব্রেইন ওয়েভে নেই। তিনি হেসে বললেন, আপনি এক জন খুবই সুস্থ মানুষ। শুধু শুধু আমার কাছে এসেছেন। আপনার অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই। মাঝে মাঝে আজেবাজে স্বপ্ন দেখি, এই অসুবিধা।
আজেবাজে স্বপ্ন তো সবাই দেখে। আমিও দেখি। একবার কী দেখলাম জানেন? বাংলা একাডেমিতে গ্ৰন্থমেলা হচ্ছে, আমি শুধু একটা আণ্ডারওয়্যার পরে সেই গ্ৰন্থমেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। হা হা হা।
মুনির হেসে ফেলল।
মিসির আলি বললেন, বাংলাদেশে ক্যাট স্কেনের কোনো ব্যবস্থা আছে? আমি এই ছেলের ব্রেইনের একটা ক্যাট স্কেন করাতে চাই!
শুধু-শুধু ক্যাট স্কেন কেন করাবেন?
পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে চাই যে, ওর মস্তিকে কোনো সমস্যা নেই।
বাংলাদেশে ক্যাট স্কেনার নেই। মাদ্রাজে নিয়ে যেতে পারেন। সেখানে আছে।
ডাক্তারের চেষার থেকে বের হয়ে মিসির আলি বললেন, তোমার নিশ্চয়ই পাসপোর্ট নেই।
জ্বি-না।
কাল সকাল দশটার দিকে এসো, পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে একটা দরখাস্ত করে দিই।
পাগল হয়েছেন নাকি স্যার?
আমি পাগল হব কেন? পাগল হচ্ছে তুমি। তা পুরোপুরি হবার আগেই একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
অনেক টাকার ব্যাপার স্যার।
তা তো বটেই। আমার কাছেও এত টাকা নেই। একটা ব্যবস্থা করতে হবে।। পাসপোর্টটা তো করা থাকুক। চা খাবে নাকি? এস, চা খাওয়া যাক।
দু জল চা খেল নিঃশব্দে। চায়ের দোকানে রেডিও বাজছে। মিসির আলি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রেডিও শুনছেন। তাঁর চোখ ছায়াচ্ছন্ন। গানের বিষাদ তাঁকে স্পর্শ করেছে।
যখন মইরা যাইবারে হাছন
মাটি হৈব বাসা।
কোথায় রইবো লক্ষণ ছিরি,
রঙ্গের রামপাশা।
মুনির অবাক হয়ে লক্ষ করল, মিসির আলির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এই মানুষটির প্রতি গভীর মমতা ও ভালবাসায় মুনিরের হৃদয় আর্দ্র হল। পৃথিবীতে ভালোমানুষের সংখ্যা কম। কিন্তু এই অল্প কজনের হৃদয় এত বিশাল, যে, সমস্ত মন্দ মানুষ তাঁরা তাঁদের হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন।
মিসির আলি রুমাল বের করে চোখ মুছে অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন। থেমেথেমে বললেন, মানুষের মন বড় বিচিত্র। এই গান আগে কতবার শুনেছি, কখনো এরকম হয় নি। আজ হঠাৎ চোখে পানিটানি এসে এক কাণ্ড। চল, ওঠা যাক।
মুনির বলল, একটু বসুন স্যার, আপনাকে একটা কথা বলি।
বল।
ঐদিন আপনি আমাকে ধলেছিলেন চেষ্টা করতে, নিজে-নিজে ঐ জগতে যেতে পারি কি না।
চেষ্টা করেছিলে?
জ্বি। আমি যেতে পারি। ইচ্ছে করলেই পারি।
বল কী?
হ্যাঁ স্যার। গত তিন দিনে আমি চার বার গিয়েছি। যাওয়াটা খুবই সহজ।
মিসির আলি চুপ করে রইলেন। মুনির বলল, আমি আপনার জন্যে দুটো জিনিস ওখান থেকে নিয়ে এসেছি।
দুটো ছবি
বল কী তুমি! দেখি!
মুনির একটা খাম এগিয়ে দিলা মৃদু গলায় বলল, বাসায় গিয়ে দেখবেন স্যার। প্লীজ।
মিসির আলি কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। ছবি দুটো দেখলেন। একটি বিয়ের ছবি-বর এবং কনে পাশাপাশি বসে আছে। তাদের ঘিরে আছে আত্মীয়স্বজন। বর মুনির। কনে নিশ্চয়ই বিনু নামের মেয়েটি।
অন্যটি স্বামী-স্ত্রীর ছবি। ওদের কোলে ফুটফুটে একটি শিশু। ছবির উলটো পিঠে লেখা —
আমাদের টগরমণি। বয়স এক বছর।
মুনির বলল, এ আমাদের ছেলে। চার বছর বয়সে মারা যায়। নিউমোনিয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা উলটাপাল্টা চিকিৎসা করেছেন।
বলতে-বলতে মুনিরের গলা আর্দ্র হয়ে গেল। আলি দীর্ঘ সময় মুনিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কোনো খবরের কাগজ আনি নি?
জ্বি-না স্যার। কিছু আনার কথা তখন মনে থাকে না। ছবিগুলো কেমন করে চলে এসেছে, আমি জানি না। ছবিগুলো হাতে নিয়ে দেখছিলাম, হঠাৎ ঘোর কেটে গেল।–দেখি আমি আমার ঘরে বসে আছি। আমার হাতে দুটো ছবি।