সিগারেট খাই, কী করে বুঝলেন? আপনার সামনে তো কখনো খাই নি।
তোমার পকেটে দেশলাই দেখেছি। তাছাড়া যে সিগারেট খায়, সে-ই সাধারণত অন্যকে সিগারেট উপহার দেবার কথা ভাবে।
দোকান থেকেই আমার খোঁজ পেলেন?
হ্যাঁ। মুনির, তুমি চা খাবে?
হ্যাঁ, খাব।
কী তুমি কথায়-কথায় স্যার বল, আজ এখন পর্যন্ত একবারও বল নি। কারণটা
স্যার, আমি চা খাব। মিসির আলি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তার মনে হল, ছেলেটি বেশ রসিক। এবং সে সহজ হতে শুরু করেছে। যত সহজ হবে, ততই তাঁর জন্যে ভালো। প্রচুর তথ্য তাঁর দরকার তথ্য ছাড়া এগুবার কোনো পথ নেই। তিনি নিজে কোনো তথ্য সংগ্ৰহ করতে পারছেন না। ছেলেটির উপরই তাঁকে নির্ভর করতে হবে!
আজ আমাকে কিছু বলবে মনে হচ্ছে?
জ্বি, বলব।
বাতি নেভাতে হবে?
না।
মুনির খুব সহজ ভঙ্গিতে নিজাম সাহেবের বাড়ির ঘটনার কথা বলল। কেমন করে হঠাৎ পট পরিবর্তন হল, সে-সময় তার অনুভূতি কী ছিল, সবই সুন্দর করে গুছিয়ে বলল। শিশুটির দেয়ালে টাঙন ছবিটির কথা, তার পানি চাইবার কথা-কিছুই বাদ দিল না! মিসির আলি একটি প্রশ্নও করলেন না। সমস্ত বৰ্ণনাটা শুনলেন চোখ বন্ধ করে। এক বাইেরও তাকালেন না।
তোমার বলা শেষ হয়েছে?
জ্বি।
তোমার বর্ণনা থেকেই মনে হচ্ছিল, বিনু মেয়েটি তোমাকে অভিভূত করেছে। রূপবতী কিশোরী মেয়ে। তার সহজ সরল ব্যবহার, তার যত্ন-এইসব তোমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই না?
জ্বি।
তুমি প্রবলভাবে মেয়েটিকে কামনা করেছ। সেই সঙ্গে তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছ। এই প্রচও কামনা বা প্রবল আকর্ষণের কারণে তোমার মধ্যে বিভ্রম সৃষ্টি হয়েছে। যার জন্যে মেয়েটিকে তুমি দেখেছ তোমার স্ত্রী হিসেবে। পুরোটাই তোমার কল্পনা। ডে-ড্রীমিং। এক ধরনের ইচ্ছেপূরণ স্বপ্ন।
হতে পারে।
আগের বার তুমি একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলে। এবার কিছু আন নি?
না।
আবার যদি কখনো এ-রকম হয়, একটা জিনিস মনে রাখবে।–কিছু একটা হাতে নেবে। খবরের কাগজ হলে খুব ভালো হয়।
খবরের কাগজ দিয়ে কী করবেন?
খবরের কাগজে একটা তারিখ থাকে। এই তারিখটা দেখব। তুমি তোমার অন্য একটা জীবনের কথা বলছি। মনে হচ্ছে দুটো জীবন পাশাপাশি চলছে। সেই জীবনের সময় এবং এই জীবনের সময়ও কি পাশাপাশি?
তার মানে আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?
না, করছি না। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারছি না। কিছু একটা দাঁড় করাতে হলে আমার প্রচুর তথ্য দরকার। সেইসব তথ্য আমার হ্রাতে নেই। তবে তুমি যে-গল্প বলছি, তার কাছাকাছি গল্প বিভিন্ন উপকথায় চালু আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একটা শুধু তোমাকে বলি! এক লোক পুকুরে গোসল করতে নেমেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত, গোসল শেষ করে বাসায় গিয়ে খাবে। পানিতে ডুব দিয়ে যেই উঠল ওম্নি সে দেখে, সব কিছু কেমন অন্য রকম লাগছে। সব অচেনা। সে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল। সে নিজেও বদলে গেছে। সে এখন আর পুরুষ নয়। রূপবতী এক যুবতী। সে কাঁপতে কাঁপতে পানি ছেড়ে উঠে এল। এক সওদাগর তখন তাকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে নিয়ে গেল। সওদাগরের সঙ্গে তার বিয়ে হল। চারটি ছেলেমেয়ে হল! তারপর একদিন দুপুরে সে সবাইকে নিয়ে গোসল করতে এসেছে। পানিতে ডুব দিয়ে ওঠামাত্র দেখল, সে তার পরিচিত জগতে উঠে এসেছে। আবার সে পুরুষ! সে দ্রুত তার বাড়িতে গেল। স্ত্রী ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছে। লোকটির মন গভীর বিষাদে আচ্ছান্ন। বারবার চারটি পুত্ৰ-কন্যার কথা তার মনে পড়ছে। ওরা কোথায় আছে, কী করছে, কে জানে? হয়তো হয়ে মাকে খুঁজছে।
মুনির বলল, এটা তো উপকথা, সত্যি নয়।
তা ঠিক। তবে সব গল্পের পেছনেই এক ধরনের সত্যি ব্যাপার থাকে। এর পেছনেও কিছু-না-কিছু থাকতে পারে। আমি এইজাতীয় সব গল্প জোগাড় করছি। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডজাতীয় যত বই পাচ্ছি পড়ছি।
মুনির ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। মিসির আলি বললেন, তুমি তোমার স্ত্রী ধ্ৰুফে-মেয়েটিকে দেখেছ, তার বয়স কি ফ্রক-পরা মেয়েটির চেয়ে বেশি মনে
হ্যাঁ, হচ্ছিল।
তোমার শোবার ঘরে জানালায় পর্দা ছিল?
হ্যাঁ, ছিল।
পর্দার রঙ মনে আছে।
জ্বি-না।
তাহলে ব্যাপারটা স্বপ্ন হবারই সম্ভাবনা। কারণ, শুধু স্বপ্নদূশ্যগুলোই হয় সাদাকালো।
আমি কিন্তু দেখেছি, ঐ মেয়েটির পরনে নীল রঙের শাড়ি।
নিজাম সাহেবের মেয়েটির পরনে নিশ্চয়ই কিছু ছিল। যে-কারণে তুমি ভাবছ তোমার স্বপ্নে দেখা স্ত্রীর গায়ের শাড়িটি নীল।
মুনির চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, নিজাম সাহেবের মেয়েটির গায়ে কী ছিল?
ফ্রক বা কামিজজাতীয় কিছু।
তার রঙ কী ছিল?
নীল।
মিসির আলি অল্প হাসলেন। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমার এই নিয়ে দু বার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। দুবারই তুমি ছিলে ক্লান্ত, বিরক্ত, হতাশ। তাই না?
জ্বি।
এখন থেকে মাঝে-মাঝে চেষ্টা করে দেখবে, নিজ থেকে ঐ জগতে যেতে পার কি না। যখন এক-একা থাকবে তখন চেষ্টা করবে। ঐ জগতে যেতে চাইবে। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করবে!
জ্বি আচ্ছা।
কোনো এক জন ভালো নিউরোলজিস্টকে দিয়েও তোমার ব্রেইন ওয়েডগুলো পরীক্ষা করাতে চাই। আমি প্রফেসর আসগর নামে এক নিউরোলজিষ্টের সঙ্গে কথাও বলে রেখেছি। তুমি কি কাল বিকেল পাঁচটায় একবার আমার কাছে আসতে পারবে?
পারব। কিন্তু স্যার, নিউরোলজিষ্ট তো অনেক টাকা নেবে!
সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।