বিনু আবার হেসে ফেললঃ হাসিমুখে বলল, যে-সব প্রশ্ন বাবাকে করা দরকার, সে-সব প্রশ্ন আপনি করছেন আমাকে! আর যে-সব প্রশ্ন আমাকে করা দরকার, সেসব করছেন বাবাকে। আপনি মানুষ এত অদ্ভুত কেন?
তুমি কিছু মনে করো না।
না, কিছু মনে করছি না। আপনার কি গরম লাগছে?
গরম লাগবে কেন? গরম লাগছে না।
ঘামছেন কেন?
বিনুর প্রশ্নের সঙ্গে-সঙ্গেই ব্যাপারটা ঘটল। চোখের সামনের জগৎ হঠাৎ কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। শব্দ অস্পষ্ট। ঘোলাটে আলোর তীব্রতা দ্রুত কমছে—-কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মুনির তুলিয়ে যাচ্ছে শব্দহীন আলোহীন এক জগতে! শরীরের কোনো ইন্দ্ৰিয় কাজ করছে না। এই অবস্থা কতক্ষণ ছিল মুনিরের মনে নেই। ঘোর কাটল। কিছু-কিছু আলো সে দেখতে পাচ্ছে। দুএকটা শব্দ কানে আসছে। মুনির ক্লান্ত গলায় বলল, পানি খাব।
এইমাত্র না পানি খেলে! আবার পানি কেন? সত্যি খেতে চাও?
মুনির স্পষ্ট করে তাকাল। সে একটা অচেনা বাড়ির অচেনা বারান্দায় বসে আছে। তার সামনে বিনু তার গায়ে ঘরোয়া ভঙ্গিতে পরা হালকা নীল রঙের একটা সুতির শাড়ি। বারান্দায় একটা পাটি পাতা। বিনু বসেছে পাটিতে। সে একটা চেয়ারে বসে আছে। রাত। বারান্দায় চাঁদের আলো আছে।
এই, সত্যি সত্যি পানি চাও?
চাই।
বিনু উঠে গেল। এই বাড়ি কার? এই মেয়েটির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, জায়গাটা কোথায়? সে কিছুই জানে না। বছরখানিক আগে প্রথম যা হয়েছিল, এও কি তাই? তার কি দুটো জীবন? এই দুটো জীবন কি পাশাপাশি চলছে?
নাও, পানি নাও!
মুনির যন্ত্রের মতো হাত বাড়াল। ঠাণ্ডা কনকনে পানি।
ও কি, গ্লাস হাতে বসে আছ কেন?
এটা কোন জায়গা?
এ আবার কি রকম কথা? কোন জায়গা মানে?
এমনি বললাম।
চল, শুয়ে পড়ি। আর কতক্ষণ বারান্দায় বসে থাকবে?
মুনির যন্ত্রের মতোই একটা ঘরে ঢুকল। এটাই বোধহয় শোবার ঘর। বেশ বড়লোকের বাড়ি মনে হচ্ছে। সুন্দর করে সাজান। দেয়ালে তিন-চার বছরের একটা ফুটফুটে শিশুর ছবি। মেয়েটি বলল, শোন, চট করে ঘুমিয়ে পড়বে না। বাবার চিঠির জবাব দিয়ে তারপর ঘুমুবো। আমার তো মনে হয় তুমি তাঁর চিঠি পড় নি এখনো। নাকি পড়েছ?
না।
পড়ে শোনাব?
শোনাও।
মেয়েটি ড্রয়ার খুলে চিঠি বের করল-গলার স্বর বুড়ো মানুষের মতো করে পড়তে শুরু করল-টুনু, তুমি দীর্ঘদিন যাবত আমার পত্রের জবাব দিতেছ না। ইহার কারণ বুঝিতে আমি অক্ষম। এক জুন বৃদ্ধ মানুষের পত্রের জবাব দেওয়া সাধারণ ভদ্রতা। চাকরি এবং সংসার নিয়া তুমি ব্যস্ত আমি জানি। দুনিয়ার সকলেই ব্যস্ত। কেহ বর্সিয়া নাই। তোমার মা বাতে আক্রান্ত। আয়ুৰ্বেদীয় চিকিৎসা চলিতেছে। তবে আমার ইচ্ছা তাহাকে ঢাকায় আনিয়া কোনো বড় ডাক্তারকে দিয়া দেখান। ঢাকায় বাত রোগের জন্য নামী ডাক্তারদের সন্ধান লইও।
বৌমাকে আদর ও স্নেহমুম্বন দিবে। তাহাকে অতি শীঘ্রই পৃথক পত্ৰ দিব। ইতি চিঠি পড়া শেষ করে মেয়েটি বলল, দেখলে, তোমার ওপর কি রকম রাগ করেছেন? একটা চিঠি লিখতে কতক্ষণ লাগে বল তো? কাগজ-কলম এনে দিই।
মুনির সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দেয়ালে টাঙন ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কার ছবি?
মেয়েটি দীর্ঘ সময় মুনিরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করছে। এই শিশুটি সম্ভবত তাদেরই। এবং খুব সম্ভব শিশুটি বেঁচে নেই। তার জন্যে মুনিরের কোনো দুঃখ বোধ হচ্ছে না। কারণ এই শিশুটিকে সে চেনে না। অতীতের কিছুই তার মনে পড়ছে না। সে দেখছে শুধু বর্তমান। এবং অদ্ভুত কোনো বর্তমান। এই বর্তমানের কোনো ব্যাখ্যা নেই। আবার বলল, ছবিটা কার?
মেয়েটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, তোমার কী হয়েছে। ছবি কার জিজ্ঞেস করছি কেন? তুমি জান না ছবি কার?
বলতে-বলতে মেয়েটি ফুঁপিয়ে উঠল। মুনিরের ঘোর কেটে গেল। সে আগের জায়গাতেই আছে। ভাত-মাছ খাচ্ছে বিনু মেয়েট পাতে এক চামচ ডাল দিল। নিজাম সাহেব বললেন, দৈ আছে। টক দৈ। ডালের সঙ্গে মিশিয়ে খাও। ভালো লাগবে!
বিনু বলল, দৈ কিন্তু বাবা নেই। বেড়াল মুখ দিয়েছিল, ফেলে দিয়েছি। ইস, আপনার বোধহয় খাওয়ায় খুব কষ্ট হল।
না, কষ্ট হয় নি।
এমন দিনে বাবা আপনাকে নিয়ে এসেছে যে, কোনো বাজার নেই। একটা যে টিম ভেজে দেব সে উপায়ও নেই। ঘরে ডিমও ছিল না।
আমার কিচ্ছু লাগবে না।
আরেকদিন কিন্তু আপনি আসবেন। আসবেন তো?
হ্যাঁ, আসব।
খবর দিয়ে আসবেন!
আচ্ছা, খবর দিয়ে আসব।
আপনি কি পান খান?
না।
মুনির বারান্দায় হাত ধুতে গেল। বিনু সঙ্গে করে পানি নিয়ে এসেছে। এখন আর বৃষ্টি নেই। মেঘ কাটতে শুরু করেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদ উঠবে। শ্রাবণ মাসের চাঁদ অপূর্ব হয়, কে জানে আজ কেমন হবে?
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, কি ব্যাপার, আজ খালি হাতে যে! আমার সিগারেট কোথায়?
মুনির লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। মিসির আলি বললেন, আজকালের মধ্যে না এলে আমি নিজেই উপস্থিত হতাম তোমার ওখানে।
আমি কোথায় থাকি তা তো আপনি জানেন না।
আগে জানতাম না। এখন জানি। শার্লক হোমসের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছি। শুনতে চাও?
প্রথমে খোঁজ করলাম ইষ্টার্ন মার্কেস্টাইলে। দেখা গেল এই নামে কোনো অফিস নেই। তুমি ভুল ইনফরমেশন দিয়েছিলে।
ভুল দিইনি। আগে এই নাম ছিল। এখন নাম বদলেছে।
যখন দেখলাম অফিস থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না, তখন পাড়ার ছোটছোট পান-বিড়ির দোকানগুলোতে খোঁজ করতে লাগলাম। কারণ তুমি সিগারেট খাও! এইসব দোকানগুলোতে তোমাকে একাধিকবার যেতে হবে।