সন্ধ্যা মেলাবার আগেই আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল।
শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি একবার শুরু হলে থামবে না। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগছে। তা লাগুক। কাগজগুলো না-তিজলেই হয়। মুনির সদর দরজা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। পা টাটাচ্ছে। বসে পড়তে ইচ্ছে করছে। বৃষ্টির জন্যেই বেশ কয়েকজন ভিখিরিণী আশ্রয় নিয়েছে। খুব অল্প সময়েই এরা কেমন গুছিয়ে নিয়েছে। পা ছড়িয়ে গল্পগুজব করছে। এক জন আবার রাস্তা আড়াল করে বসে বিড়ি ধরিয়েছে। মুনিরকে দেখে একটু লজ্জালজ্জা পাচ্ছে। অন্য এক জনের কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। সে বাচ্চাটির সঙ্গে নিচুগলায় কী সব গল্প করছে। এ-রকম ছোট তিন-চার বছরের শিশুর কোনো গল্প বোঝার কথা নয়। কিন্তু শিশুটি মনে হয় বুঝতে পারছে।
বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ নেই। রাস্তায় একহাঁটু পানি। এই পানি ভেঙে এজিএম সাহেবের গাড়ি আসূবে না। তিনি নতুন গাড়ি কিনেছেন। গাড়ির গায়ে এক ফোঁটা পানি পড়লে আঁৎকে ওঠেন।
বৃষ্টির বেগ ক্রমেই বাড়ছে। শ্রাবণ মাসে ঝড় হবার কথা শোনা যায় না, বাতাসের গতিক দেখে মনে হচ্ছে ঝড় হবে। পাশের চায়ের দোকান ঝাঁপ বন্ধ করছে।
মুনির, এই মুনির।
মুনির চমকে উঠল। নিজামুদিন সাহেব। পায়জামা হাঁটু পর্যন্ত তোলা। মাথায় ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভিজে জীবজব করছেন। পাঞ্জাবি লেপ্টে গায়ের সঙ্গে মিশে আছে।
আমার তাই সন্দেহ হচ্ছিল। এই জন্যই এলাম, তুমি আছ এখনো?
বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি।
বৃষ্টি তো শুরু হল সুন্ধ্যাবেলায়। কোন আক্কেলে তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলে! তুমি কি বায়েজিদ বোস্তামী? আবার হাসছ? এর মধ্যে হাসির কী হল!
আপনি আমার খোঁজে আবার এলেন?
আসব না তো কী করব? বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল ভূমি এখনো আছ। এর নাম হচ্ছে ইনটুশন। এখন চল আমার সঙ্গে। নাকি সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবে?
কোথায় যাব?
আমার বাসায়! আমার সঙ্গে আজ খাবে। তুমি মহা মুর্থ। মহা-মহা মুর্থ।
নিজাম সাহেবের বাসা ভূতের গলিতে। দু-কামরার টিনের ঘর। কাঁচা রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। জায়গায়-জায়গায় খানাখন্দ। স্ট্রীট লাইট নেই। ইলেকট্রিসিটি না থাকায় সমস্ত অঞ্চলটাই অন্ধকারে ডুবে আছে। নিজাম সাহেব হাত ধরে- ধরে মুনিরকে নিয়ে যাচ্ছেন। কাদায় পানিতে দু জনই মাখামাখি। নিজাম সাহেব সারা পথ গালাগালি করতে-করতে আসছেন। কিছুক্ষণ পর-পর বলছেন, তুমি মহা মুর্থ।
মুনিরের বড় ভালো লাগছে। অনেক দিন পর সে কোনো মানুষের মধ্যে এমন গাঢ় মৃত্যুর পরিচয় গেল। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে ভদ্রলোক এক-একা গিয়েছেন খোঁজ নিতে।
বাড়ি পৌঁছামাত্র গরম পানির ব্যবস্থা হল। নিজাম সাহেব ঠেলে তাকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। বাথরুম অন্ধকার। সারা বাড়িতে একটামাত্ৰ হারিকেন।
মুনির।
জ্বি।
তাকে সাবান আছে।
কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।
দরজা বন্ধ করার দরকার কী? খোলা রাখা।
মুনির দরজা অল্প একটু ফাঁক করল। ভেতরবাড়ির সবটা দেখা যাচ্ছে। ফ্ৰক-পরা একটি কিশোরী মেয়ে বারান্দায় কেরোসিন কুকারে রান্না চড়িয়েছে। মেয়েটির পাশে ভেজা-কাপড়ে নিজাম সাহেব। কি যেন বলছেন মেয়েকে, আর মেয়ে বারবার হোসে উঠছে। অন্ধকারে এই হাসির শব্দ এত মধুর লাগছে!
বাড়িতে আর কোনো লোকজন নেই। নিজাম সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন। অল্প কিছুদিন আগে। দেশের বাড়িতে গিয়ে জ্বরে পড়েছিলেন। জ্বরের সঙ্গে ধীরে-ধীরে আরো সব উপসর্গ যুক্ত হল। খবর পেয়ে নিজাম সাহেব গেলেন দেশে। তিনদিনের আর্নড লীত নিয়ে গিয়েছিলেন। দু দিনের দিন ফিরে এসে যথারীতি হিসাবের খাতা নিয়ে বসলেন। বিকেলে অফিসের ছুটির পরও বসে রইলেন। মুনির এসে বলল, নিজাম ভাই বাসায় যাবেন না? নাকি আজও হিসাবের গণ্ডগোল আছে?
নিজাম সাহেব শান্ত গলায় বললেন, অন্যের হিসাব মিলিয়ে দিয়েছি। নিজেরটা মেলে না। আমার স্ত্রী মারা গেছে। বাড়ি গিয়ে দেখি দশ মিনিট আগে ডেডবডি কবর দিয়ে ফেলেছে। অনেকেই বলেছিল। কবর থেকে আবার তোলা হোক। শেষ দেখা। আমি নিষেধ করলাম।
নিজাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তার চেহারায় বা আচার-আচরণে শোকের কোনো ছাপ নেই। অফিসের হিসাব না-মিললে এই মানুষটি অনেক বেশি বিচলিত হয়।
পাটি বিছিয়ে খাওয়ার আয়োজন। উচ্ছে ভাজা, চিংড়ি মাছ, ডাল এবং একটা শক্তি। কিশোরী মেয়েটি খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। মেয়েটির মুখ গোলাকার, নাক ঈষৎ চাপা। তবু ভারি মিষ্টি লাগছে মেয়েটিকে মেয়েটির কথাবার্তায় কোনো আড়ষ্টতা নেই, যেন মুনিরকে সে অনেক দিন থেকে চেনে। মেয়েটি মিষ্টি রিনরিনে গলায় কথা বলছে এবং খুব কৌতূহলী চোখে মুনিরকে দেখছে।
বাবা প্রায়ই বাসায় এসে বলেন, আপনি নাকি বাবার হিসাব মিলিয়ে দিয়েছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার অফিসে যাবার সময় বলেন–ছেলেটিকে দাওয়াত করব। আপনাকে বোধহয় আর বলেন না। নাকি বলেন, আপনি আসেন না?
মুনিরের কেন জানি লজ্জা করছে। চোদ্দ-পনের বছরের বাচ্চা একটি মেয়ে, তবু কেন মুনির সহজ হতে পারছে না।
ভাই, আপনার কি একটিই মেয়ে?
হ্যাঁ, বিনুর বড় একটা ভাই ছিল। জন্মের পরপর মারা গেছে।
আপনার মেয়ে কী পড়ে?
বিনু হেসে ফেলে বলল, আপনি বাবাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করুন। আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন?
কী পড় তুমি?
আইএ পড়ি।
নিজাম সাহেব বললেন, আর পড়াশোনা হবে না। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এ দেশে বিয়ের পর মেয়েদের পড়াশোনা হয় না।