আমি আমার ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি।
মিসির আলি ঠিকানা লিখলেন। মন্ত্রিক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনি জিগাতলায় থাকেন?
জ্বি।
রহমান সাহেবের বাসা চেনেন? ২২/১৩, তিনতলা বাড়ি। আই স্পেশালিস্ট টি রহমান।
জ্বি-না। তবে আপনি যদি তাঁদের কাছে কোনো খবর পাঠাতে চান, আমি ঠিকানা বের করে খবর পৌঁছে দেব।
কোনো খবর দিতে হবে না।
ও-বাড়ি থেকেই কি করে আসার কথা ছিল।
আপনি কী করে বুঝলেন?
অনুমান করছিলাম।
ডাক্তার এ মল্লিক অপ্ৰসন্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি চিন্তিত ও বিরক্ত। তাঁর আজকের ছুটির দিনটি নষ্ট হয়েছে।
যাই ডাক্তার সাহেব?
তিনি জবাব দিলেন না।
মতিঝিল পাড়ার অফিস
মতিঝিল পাড়ার অফিস। নাম আলফা ট্রান্সপোর্ট। নাম থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, তবে কাজকর্ম পাঁচমিশালি–অটোমোবাইল ইন্সুরেন্স, ট্রাভেল এজেন্সি এবং ইণ্ডেনটিং।
বৃহস্পতিবার অর্ধেক দিন অফিস। মুনিরের হাতে তেমন কোজ নেই। সে বসেছে এ্যাসিসটেন্ট ক্যাশিয়ার নিজামুদ্দিন সাহেবের পাশে। নিজামুদ্দিন সাহেবের ব্যালেন্স শীটে সতের টাকার গণ্ডগোল। হিসাব মিলছে না। তিনি মুনিরকে ডেকে নিয়ে গেছেন, যাতে সে ঠাণ্ডা মাথায় ফিগারগুলি চেক করতে পারে।
নিজামুদ্দিন সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এল ডি ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছিলেন। দুটো প্রমোশন পেয়ে এ্যাসিষ্ট্যান্ট ক্যাশিয়ার হয়েছেন। গত বছর একটা গুজব উঠেছিল, তিনি অফিসার্স গ্রেড পাচ্ছেন। তা পান নি। তাঁর পাঁচ বছরের জুনিয়র শমসের সাহেব পেয়েছেন। এই নিয়ে নিজামুদ্দিন সাহেবের মনে কোনো ক্ষোভ নেই। দিনের শেষে ক্যাশের হিসাব পুরোপুরি মিটে গেলেই তিনি মহাসুখী। এই হিসাব তাঁর প্রায়ই মেলে না। তখন তাঁকে দেখে মনে হয়, তাঁর মাথা-খারাপ হতে বেশি বাকি নেই!
এই মানুষটিকে মুনিরের খুব পছন্দ। ভদ্রলোক সব কিছুই অত্যন্ত দ্রুত করেন। দ্রুত কথা বলেন। দ্রুত লেখেন এবং দ্রুত রেগে যান। অতি দ্রুত রাগ চলেও যায়। তখন ধরা গলায় বলেন, মিসটেক হয়েছে। মনের মধ্যে কিছু রাখবেন না, তাহলে কষ্ট পাব। এক্সকিউজ করে দেন।
জুনিয়র কর্মচারীদের কেউ তাঁকে স্যার বললে তিনি শীতল গলায় বলেন, আমাকে স্যার ডাকবেন না। স্যার ডাকলে নিজেকে মাস্টার-মাস্টার মনে হয়। বরং ভাই ডাকবেন। ব্রাদারের উপর কোনো ডাক হয় না।
মুনির নিজেও সতের টাকার কোনো সমাধান করতে পারল না। দেখা যাচ্ছে ক্যাশে সতের টাকা আসলেই কম। নিজামুদ্দিন সাহেবের মুখ অন্ধকার। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন-ঘন।
মুনির বলল, নিজাম ভাই, আপনি আজ চলে যান। শনিবার না হয় আরেক বার দেখব।
শনিবার দেখলে তো হবে না। দিনের হিসাব মেটাতে হয় দিনে। তিনি নিজের পকেট থেকে সতেরো টাকা রাখলেন আয়রন সোফে। কাগজপত্র সই করলেন। মুনিরের খুব মন-খারাপ হল।
বেচারার সতের টাকা চলে গেল, এই জন্যে নয়, যে-হিসাবের জন্য ভদ্রলোকের এত মমতা সেই হিসাব মিলছে না দেখে। মুনিরের মনে হচ্ছে এই সরল-সহজ মানুষটা হয়তো কেঁদে ফেলবে।
নিজাম ভাই।
কি?
আসুন, আরেক বার আমরা দুজন মিলে বসি। চেক এবং কাউন্টার চেক। তাউচারগুলিও দেখেন। কোনোটা হয়তো ইংরেজিতে লেখা, তুলেছেন বাংলায়।
নিজামুদ্দিন সাহেবের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি অত্যন্ত উৎসাহে কাগজপত্র বের করলেন। মুনির কাগজপত্র নিয়ে বসতে পারল না। এজিএম কাদের সাহেব ডেকে পাঠালেন। নরম গলায় বললেন, আমাকে কয়েকটা জিনিস টাইপ করে দিতে পারবে?
প্রশ্ন থেকেই বোঝা যায় অফিসের কোনো কাজ নয়। অফিসের কাজ হলে বলতেন, খুব জরুরি। টাইপরাইটার নিয়ে বসে যাও। মিসটেক যেন না-হয়। স্পেসিং ঠিক রাখবে।
এখন তা বলছেন না। নরম স্বরে কথা বলছেন। এজিএম ধরনের কেউ নরম স্বরে কথা বলে–এটাও এক অভিজ্ঞতা।
একটু এক্সটা টাইম কাজ করতে হবে, পারবে?
পারব স্যার।
গুড।
কাদের সাহেব মানিব্যাগ খুলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে একটা দশ টাকার নোট বের করলেন।।
নাও দুপুরে কিছু খেয়ে নিও।
কিছু লাগবে না স্যার!
আরো নাও নাও।
মুনির হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। নিজেকে তার ভিখিরির মতো মনে হচ্ছে। অথচ না নিয়েও উপায় নেই। কাদের সাহেব টাকা না নেয়ার অন্য অর্থ করে বসতে পারেন!
কতক্ষণ লাগবে?
ঘন্টাখানিক!
গুড। আমি একটু বেরুচ্ছি। একঘন্টা পরে এসে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?
জ্বি আচ্ছা স্যার।
একটার মধ্যেই কাজ শেষ–এজিএম সাহেবের দেখা নেই। অফিস খালি হয়ে গেল দেড়টার মধ্যে। দারোয়ান তালাচাবি লাগিয়ে দিল। নিজাম সাহেব বললেন, তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?
এ ছাড়া আর কি করব?
একা একা কতক্ষণ দাঁড়াবে? আমিও অপেক্ষা করি?
আপনি চলে যান নিজাম ভাই। স্যার এসে পড়বেন। জরুরি কাজ।
জরুরি কাজ না হাতি। জরুরি কাজ হলে চলে যেত না। পাশে বসে থাকত।
আপনি চলে যান নিজাম ভাই।
একা তোমাকে রেখে চলে যেতে খারাপ লাগছে।
আমি বেশিক্ষণ থাকব না। এই ঘন্টাখানিক।
ঘন্টাখানিক নয়, মুনির সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কাগজগুলো হয়তো জরুরি। আগামীকাল ছুটি। কাদের সাহেব এই ছুটির মধ্যে তাকে খুঁজে পাবেন না। সেও কদের সাহেবের বাসার ঠিকানা জানে না।
মুনিরের রীতিমতো কান্না পেতে লাগল। বারান্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টের সময় কাটতেই চায় না। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। অফিসের পাশেই চায়ের দোকান আছে একটা। টোষ্ট, কলা এইসব পাওয়া যায়। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। বরং নিজেকে কোনো-না-কোনোভাবে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে। মুনির ঠিক করল, রাতেও সে কিছু খাবে না। দুগ্নিাস পানি খেয়ে শুয়ে থাকবে। মাঝে-মাঝে সে এ-রকম করে।