সাজ্জাদ হোসেন অফিসের টেবিলেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করছেন। গত রাতে এক ফোঁটাও ঘুমোন নি। দিনের বেলায়ও ঘন্টাখানেকের মতো শোবার সময় পাওয়া যায় নি। এবং খুব সম্ভব আজ রাতটাও তাঁর জেগেই কাটবে। লোহার রড হাতের সেই নগ্নগাত্ৰ আগন্তক তাঁর সর্বনাশ করে দিয়েছে। পুলিশবাহিনীর নাকের ডগায় আরেকটি খুন হয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
একটি লোক রোজ রাতে লোহার রড হাতে একই জায়গায় ঘোরাঘুরি করবে, অথচ তাকে ধরা যাবে না–এটা কেমন কথা!
স্যার, আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান।
সাজ্জাদ হোসেন টেবিল থেকে মাথা তুললেন। তাঁর অডারলি দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকটির কি কোনো বুদ্ধিাশুদ্ধি নেই? তাকে বলে দিয়ে এসেছেন, যেন কিছুতেই আগামী দু ঘন্টার মধ্যে তাঁকে ডাকা না হয়। অথচ দশ মিনিট পার না-হতেই ব্যাটা ডাকতে এসেছে। তিনি বরফশীতল গলায় বললেন, বল আমি নেই।
স্যার, আমি বলেছি যে আপনি আছেন। তাতে অসুবিধা নেই। এখন গিয়ে বল যে, আমার আগের কথাটা ঠিক না। উনি আসলে নেই, কোথায় গিয়েছেন কেউ জানে না।
স্যার, উনি এক জন সাংবাদিক। পত্রিকা অফিস থেকে এসেছেন।
সাজ্জাদ হোসেন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। সাংবাদিকদের বিরাগভাজন হবার মতো সাহস তাঁর নেই। পত্রিকায় দীর্ঘ আর্টিকেল বের হয়ে যাবে–পুলিশ অফিসারের দুর্ব্যবহার।
আসতে বল, আর শোন–দু কাপ চা দিতে বল।
সাংবাদিক ভদ্রলোকের নাম মীরউদ্দিন। ভদ্রলোক শুধু যে পেশায় সাংবাদিক তাই নয়।–চেহারায়, পোশাকে, এমনকি হাবেভাবেও সাংবাদিক। প্রশ্নের ধরন ডিটেকটিভের মতো। প্রতিটি বাক্যের শেষে একটি খোঁচা আছে, যা ঠিক সহ্য করা মুশকিল। সাংবাদিক, কাজেই সহ্য করতে হবে। এবং কিছুতেই চটানো যাবে না। মীরউদ্দিনের কাছ থেকে জানা গেল যে, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা নগ্নগাত্র বিভীষিকা–এই শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপবে। কাজেই পুলিশের বক্তব্যটি শোনবার জন্যে তিনি দয়া করে এখানে তশরিফ রেখেছেন।
আমার প্রশ্নের জবাব দিতে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?
না, নেই। প্রশ্ন করুন।
নগ্নগাত্র ব্যক্তিটি প্রসঙ্গে আপনার কী ধারণা?
তেমন কোনো ধারণা নেই। পাগল-টাগল হবে। আর কি।
তাকে পাগল বলার পেছনে আপনার যুক্তি কী?
একটাই যুক্তি—কোনো সুস্থ মাথার লোক একটা লোহার রড নিয়ে খুনখারাবি করে বেড়ায় না।
কেন, সুস্থ লোকও তো খুনখারাবি করে।
তা করে, কিন্তু তার পেছনে কোনো মোটিভ থাকে। এর কাণ্ডকারখানার পেছনে কোনো মোটিভ নেই।
বুঝলেন কি করে, মোটিভ নেই? হয়তো মোটিত আছে, আপনারা ধরতে পারছেন।
সাজ্জাদ হোসেনের বিরুক্তির সীমা রইল না। এ তো মহা ত্যাঁদড়ের পাল্লায় পড়া গেল! জ্বালিয়ে মারবে মনে হচ্ছে।
নগ্নগাত্রকে নিয়ে পুরানা পল্টন এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা কি আপনি জানেন?
না, জানি না। কী গুজব?
সেটা আপনি নিজেই কষ্ট করে জেনে নেবেন। কারণ পুলিশের উচিত শহরের চালু গুজবগুলোর প্রতি লক্ষ রাখা। কি, উচিত না?
সাজ্জাদ হোসেন জবাব দিলেন না। এই লোকের সঙ্গে কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো।
এখন আপনি দয়া করে বলুন, লোকটিকে ধরবার ব্যাপারে পুলিশবাহিনী কি চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থতার পরিচয় দেয় নি?
না। ধরবার চেষ্টা হচ্ছে, শিগগিরই ধরা পড়বে। হয়তো আজ রাতেই ধরা পড়বে।
আচ্ছা, বিদেশে অপরাধীকে ধরবার জন্যে ট্ৰেণ্ড পুলিশ-কুকুর আছে, এরা গন্ধ শুঁকে—শুঁকে অপরাধীকে বের করে ফেলে। এখানে এমন কিছু নেই?
না, নেই। কারণ এটা বিদেশ নয়, বাংলাদেশ।
কিন্তু বাংলাদেশে তো পুলিশবাহিনীর একটা মাউন্টেড রেজিমেন্ট আছে। যার প্রতিটি ঘোড়া লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করে কেনা। অপ্রয়োজনীয় ঘোড়ার পেছনে এত টাকা খরচ না করে দু-একটা শিক্ষিত কুকুর কি কেনা যায় না?
আমাকে এ সব বলছেন কেন তাই? আমি সামান্য ব্যক্তি। এ সব কর্তাব্যক্তিদের বলেন।
আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। উচিত কি উচিত না।
উচিত তো বটেই।
সাজ্জাদ হোসেন উঠে পড়লেন। শুকনো গলায় বললেন, আমার ডিউটি আছে। আর থাকতে পারছি না। এই সাংবাদিকের সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটালে প্যাঁচে পড়ে যেতে হবে। চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। আজকের ইন্টারভ্যু দিয়েই তাঁর ভয়ভয় লাগছে, না-জানি কী ছাপা হয়! তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। চাকরি বাঁচিয়ে চলা ক্রমেই মুশকিল হয়ে পড়ছে।
সাজ্জাদ হোসেন জীপ নিয়ে খানিকক্ষণ একা-একা পুরানা পন্টন এলাকায় ঘুরলেন। তারপর খুঁজে বের করলেন মিসির আলির বাড়ি।
এটা সেই বাড়ি, যা নগ্নগাত্ৰ এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। তাঁর জানা ছিল না। মিসির আলির সঙ্গে এর পরেও তাঁর দেখা হয়েছে, কিন্তু মিসির আলি এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। যেন এটা বলার মতো কোনো ব্যাপার নয়। অথচ মিসির আলিকে দুতিন বার স্টেটমেন্ট দিতে হয়েছে। এক জন ইনভেসটিগেটিং অফিসার এসে সব দেখেশুনে গিয়েছে। যথেষ্ট হৈচৈ করা হয়েছে এটা নিয়ে। অন্য যে-কেউ হলে প্রথম সুযোগেই ঘটনাটা বন্ধুবান্ধবদের বলত। মিসির আলি বলেন নি। লোকটি কি ইচ্ছে করেই নিজেকে আলাদা প্ৰমাণ করবার জন্যে এ-রকম করে?
সাজ্জাদ হোসেন কড়া নাড়লেন। মিসির আলি ঘরেই ছিলেন। তিনি দরজা খুললেন। সাজ্জাদ হোসেনকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না। তাঁর ভাবতঙ্গি দেখে মনে হল, তিনি যেন বন্ধুর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।