গত পরশু রাতে কে যেন তালা ভেঙে আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করেছে।
আপনি বাসায় ছিলেন না?
আমি তো স্যার প্রথমেই আপনাকে বলেছি তালা ভেঙে ঢুকেছে। কাজেই আমার ঘরে থাকার প্রশ্ন ওঠে না।
সাইদুর রহমান সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন।
মিসির আলি বললেন, আমি ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছি। দিন দশেকের ছুটির আমার খুব দরকার।
রহমান সাহেব মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস-টলাস তো এমনিতেও হয় না। এর মধ্যে আপনারা ছুটি নিলে তো অচল অবস্থা। এর চেয়ে আসুন, সবাই মিলে ইউনিভার্সিটি তালাবন্ধ করে চলে যাই, কী বলেন?
মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, আপনি কি স্যার আমার সঙ্গে রসিকতা করতে চেষ্টা করছেন?
রসিকতা করব কেন?
গত দু বছরে আমি কোনো ছুটি নিই নি। এখন নিতান্ত প্রয়োজনে চাচ্ছি। দিতে না চাইলে দেবেন না। আপনার নিজের কী অবস্থা। এ-বছরে আপনি কি কোনো দুটি নেন নি?
অন্যের সঙ্গে সবসময় একটা কমপেয়ার করার প্রবণতাটা আপনার মধ্যে খুব বেশি। এটা ঠিক না মিসির আলি সাহেব। আপনি সি. এল-এর ফরমটা রেখে যান, আমি রিকমেন্ড করে দেব।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। সাইদুর রহমান বললেন, উঠবেন না, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। বসুন।
তিনি বসলেন। জরুরি কথাটা কি আঁচ করতে চেষ্টা করলেন। সাইদুর রহমান সাহেবের মুখ হাসি-হাসি। কাজেই কথাটা মিসির আলির জন্যে নিশ্চয়ই সুখকর হবে না।
আপনার পার্ট টাইম অ্যাপিয়েন্টমেন্টের মেয়াদ তো শেষ হতে চলল। এক্সটেনশনের জন্যে কী করছেন?
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমাকে কিছু করতে হবে নাকি। আমার তো ধারণা ছিল, আমার কিছু করার নেই। ইউনিভার্সিটি যা করার করবে।
সাইদুর রহমান সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল। এর মানে কী? তাঁকে কি এক্সটেনশন দেয়া হবে না? সেটা তো সম্ভব নয়। যেখানে ফুল টাইম টীচার অ্যাপিয়েন্টমেন্ট হবার কথা, সেখানে পার্ট টাইম চাকরির এক্সটেনশন হবে না? এটা কেমন কথা!
স্যার, আপনি ঠিক করে বলেন তো ব্যাপারটা কি। আমার মেয়াদ শেষ?
এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এক জনের এডহক অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো হয়েছে। এখন আর আমাদের টীচারের শর্টেজ নেই।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। খাজনার থেকে বাজনা বেশি। ছাত্রের চেয়ে টীচারের সংখ্যা বেশি।
মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করি নি। আপনি কেন আমার পেছনে লেগেছেন?
আরে, এটা কী বলছেন। আমি আপনার পেছনে লাগিব কেন? কী ধরনের কথা এ-সব?
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। আর এখানে বসে থাকার কোনো মনে হয় না!
সাইদুর রহমান সাহেব বললেন, কি, চললেন?
হ্যাঁ, চললাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়? তাঁরা কি কিছু করতে পারবেন? পারবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এ-জাতীয় কারোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কমসংখ্যক অধ্যাপককেই তিনি চেনেন।
স্যার স্নামালিকুম।
মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন, দুটি ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, তোমরা কিছু বলবে?
জ্বি-না স্যার।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
তিনি হাঁটছেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে চাকরি চলে গেলে তিনি অথই পানিতে পড়বেন। সময় ভালো না। দ্বিতীয় কোনো চাকরি চট করে জোগাড় করা মুশকিল। সঞ্চয় তেমন কিছু নেই। ইচ্ছা করলে সঞ্চয় করা যেত। ইচ্ছা করে নি। এ পৃথিবীতে কিছুই জমা করে রাখা যায় না। সব খরচ হয়ে যায়।
মিসির আলি হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বললেন, I cannot and will not believe that man can be evil.
তাঁর প্রিয় একটি লাইন। প্রায়ই নিজের মনে বলেন। কেন বলেন? এই কথাটি কি তিনি বিশ্বাস করেন না? যা আমরা বিশ্বাস করি না, অথচ বিশ্বাস করতে চাই, তা-ই আমরা বারবার বলি।
তিনি ঘড়ি দেখলেন। তিনটা বাজে। শরীর খারাপ লাগছে। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু অনেক কাজ পড়ে আছে। আজমলের সঙ্গে দেখা করা এখনো হয়ে ওঠে নি। ফিরোজের সঙ্গে দেখা করতে পারেন নি। তার সঙ্গে দেখা করার সব কটি প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে। অথচ খুব তাড়াতাড়ি দেখা করা দরকার! সাজ্জাদ হোসেনেরই-বা খবর কি? সে কি হানিফ সম্পর্কে কোনো তথ্য পেয়েছে? না কোনো চেষ্টাই করে নি?
নীলুর সঙ্গেও আর দেখা হয়নি। এর মধ্যে দুবার গিয়েছেনঝিকাতলায়। দুবারই বাসার সামনে থেকে চলে এসেছেন। কেন যে তাঁর লজ্জা লাগছিল! লজ্জার কী আছে? কিছুই নেই। তিনি যাচ্ছেন তাঁর ছাত্রীর বাসায়। এর মধ্যে লজ্জার কী?
লাইব্রেরি থেকে একটা বই ইস্যু করার কথা–ইলুশন অ্যান্ড হেলুসিনেশন, ডঃ জিম ম্যাকার্থির বই। প্রচুর কেইস হিষ্টি আছে সেখানে। কেইস হিষ্টিগুলো দেখা দরকার। কোনোটার সঙ্গে কি ফিরোজের বা নীলুর ব্যাপারগুলো মেলে? পুরোপুরি নামিললেও অনেক উদাহরণ থাকবে খুব কাছাকাছি। সেগুলো খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
মিসির আলি লাইব্রেরিতে চলে গেলেন। সাধারণত যে-বইটি খোঁজা হয়, সে বইটিই পাওয়া যায় না। ভাগ্যক্রমে এটি ছিল। চমৎকার বই। তিন শর মতো কেইস হিষ্টি আছে। আজ রাতের মধ্যেই শেষ করে ফেলতে হবে। তিনি ষ্টিভিনশনের সমনোমাবলিক প্যাটার্ন বইটিও নিয়ে নিলেন। এটিও একটি চমৎকার বই। তাঁর নিজেরই ছিল। তাঁর কাজের ছেলেটি পুরানো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছে। মহা বদমাশ ছিল। তাঁকে প্রায় ফতুর করে দিয়ে গেছে। তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মানুষ কত বিচিত্র। এই ছেলেটিকে তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন। স্নেহ অপাত্রে পড়েছিল। মানুষের বেশির ভাগ স্নেহ-মমতাই অপাত্রে পড়ে।