স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নেবে মনে করে সুটকেস থেকে কাপড়, টাওয়েল আর সাবান বের করে নিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে। দেখল রানা দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। একটু ধাক্কাধাক্কি করে, বুঝল ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। মিনিট পাঁচেক পরে খুট করে বল্টু খোলার শব্দ পাওয়া গেল। আরও দু’মিনিট পার হয়ে গেলেও যখন কেউ বেরিয়ে এল না, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে রানা গিয়ে ঢুকল বাথরুমে। ওটা পাশাপাশি দুটো ঘরের। কমন বাথরুম। পাশের ঘরের ভদ্রলোক কাজ সেরে এদিকের বন্টু খুলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছেন।
মিনিট দশেক শাওয়ারের ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করে সন্তুষ্ট মাসুদ রানা গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে, ওদিকের বল্টুটা খুলে দেয়ার কথা। বেমালুম ভুলে গেছে।
ঠিক বিকেল পাঁচটায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রানার। দরজা খুলেই দেখল, বিশ-বাইশ বছর বয়সের, অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। মুখে এক-ফোঁটা মেক-আপ নেই, শুধু কপালে একটা লাল কুমকুমের টিপ। খোলা এলোচুল। চোখ দুটো একটু ফোলা-এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে মনে হচ্ছে। পরনে হালকা নীল অর্গাণ্ডির ওপর সাদা ছাপ দেয়া সাধারণ শাড়ি। সাংস্কৃতিক মিশনের কোনও শিল্পী হবে হয়তো। চোখ দুটো ঝলসে যাবার যোগাড় হলো রানার মেয়েটির একই অঙ্গে এত রূপ দেখে।
‘ভেতরে আসুন,’ বলল রানা।
‘আপনাকে বিরক্ত করতে হলো বলে আমি দুঃখিত। পরিষ্কার বাংলায় বলল মেয়েটি। কথা ক’টা যেন নিক্তি দিয়ে ওজন করা। একটু ফাঁসফেঁসে মেয়েটির কণ্ঠস্বর। যেন বেশ কিছুটা বাধা পেরিয়ে বেরোচ্ছে শব্দ। কিন্তু তীক্ষ্ণ অদ্ভুত একটা। মাদকতা আছে সে স্বরে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবার কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না তার। চোখে মুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ।
এক সেকেণ্ডে রানার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। ও বলল, ‘আর আপনাকে দুঃখিত অবস্থায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে আমি বিস্মিত, তারপর চিন্তিত এবং সবশেষে একান্ত লজ্জিত। এক্ষুণি আমি বল্টু খুলে দিচ্ছি বাথরুমের। আর এই জোড়হাত করে মাফ চাইছি–জীবনে কোনওদিন আর এমন কাজ করব না।
হেসে ফেলল মেয়েটি। রানার ভণ্ডামি দেখে রাগ জল হয়ে গেছে তার।
‘বেশ লোক তো আপনি! ইচ্ছে করেই ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছিলেন নাকি?
না। সত্যি বলছি, ভুলে। ছি ছি ছি, দেখুন তো, আপনাকে কত অসুবিধের মধ্যে ফেললাম! আন্তরিক লজ্জিত হলো রানা।
‘আপনি কী করে বুঝলেন আমি পাশের ঘরেই আছি এবং এই কারণেই এসেছি?’
‘দেখুন, আমি নিতান্ত শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ। তবে ভয় পেলে কেন জানি আমার বুদ্ধি খুলে যায়। আপনার অমন মারমুখো মূর্তি দেখেই ভড়কে গিয়ে আমার মাথাটা খুলে গিয়েছিল। আর তা ছাড়া…’
‘মিত্রা!’ একটা ভয়ানক গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
চমকে উঠে রানা চেয়ে দেখল একজন লোক এগিয়ে আসছে বারান্দা ধরে। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা। বয়েস চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে-ঠিক কত বোঝা যায় না। পরনে শান্তিপুরী ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবী-কালো জহর কোট চাপানো তার ওপর। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি, আর সারাটা মাথা জুড়ে চকচকে টাক। অদ্ভুত ফর্সা। গায়ের রঙ। বড় বড় কানের ফুটো। দেহের সঙ্গে বেমানান প্রকাণ্ড গোল মাথাটা কাঁধের ওপর চেপে বসে আছে-ঘাড়ের চিহ্নমাত্র নেই। আরেকটু কাছে আসতেই রানা লক্ষ্য করল পূর্ণিমার চাঁদের সমান গোল মুখটায় দাড়ি, গোঁফ, ভুরু, কিছু নেই-বোধহয় কোনদিন ওঠেইনি; কিংবা ঝরে পড়েছে Alopecia totalis রোগে। ছোট ছোট লম্বাটে হলুদ মঙ্গোলিয়ান চোখ দুটো নিপ্রভ, অভিব্যক্তিহীন। লালচে পুরু ঠোঁট দুটো ঘেন্না ধরায়। মুখের দুই কোণে আবার ঘায়ের চিহ্ন। সবটা মিলিয়ে অদ্ভুত রকমের বিশ্রী চেহারা লোকটার। এক নজরেই অপছন্দ করল রানা লোকটাকে। লোকটার চারপাশে একটা অশুভ ছায়া দেখতে পেল সে। বিপদ, ভয় আর অমঙ্গলের প্রতীক যেন লোকটা।
জিভ দিয়ে বাঁ দিকের ঘা-টা ভিজিয়ে নিয়ে মিত্রার দিকে চেয়ে সে বলল, ‘এখানে কী করছ মিত্রা, ঘরে যাও।
বিনা বাক্যব্যয়ে মাথা নিচু করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল মিত্রা। এবার রানার ওপর চোখ পড়ল লোকটির। ভয়ঙ্কর হলুদ দৃষ্টি মেলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে রানাকে। সাপের মত পলকহীন সে দৃষ্টি। অস্বস্তি বোধ করল রানা সেই ঠাণ্ডা দৃষ্টির সামনে। সাধারণ ভদ্রতার খাতিরে রানা বলল, ‘আমার নাম…’
তরিকুল ইসলাম। এপিপি-র ফটোগ্রাফার। রানার বক্তব্য নিজেই বলে দিল লোকটা। আর আমার নাম জয়দ্রথ। জয়দ্রথ মৈত্র। এই শুভেচ্ছা মিশনের অধিকারী। পরে ভাল করে আলাপ হবে, মি. ইসলাম-এখন আমি একটু ব্যস্ত।
ডান দিকের ঘা-টা চেটে নিয়ে ধীর পায়ে চলে গেল জয়দ্রথ মৈত্র। রানাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ যেন ভূতে ভর করেছিল ওর ওপর।
বাথরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে একটা ইজি চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিল রানা। তারপর একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে চোখ বুজে মারল কষে লম্বা টান। জয়দ্রথ মৈত্রের চেহারাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তা হলে এই হচ্ছে ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের সেই ভয়ঙ্কর H-যার সঙ্গে সংঘর্ষে বহু পাকিস্তানী দুঃসাহসী সিক্রেট এজেন্ট নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ একটি আঁচড়ও পড়েনি এর গায়ে। অদ্ভুত বুদ্ধিমান এবং কৌশলী এই H সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মেজর জেনারেল রাহাত খান পর্যন্ত সমীহ প্রকাশ না করে। পারেন না। দুর্দান্ত এই ভয়ঙ্কর লোকটির পাশে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হলো রানার। মাথা ঝাঁকিয়ে এই ভাবটা দূর করবার চেষ্টা করল মাসুদ রানা। মিত্রার কথা ভাবতে চেষ্টা করল। এই মেয়েটিকে কী শুধুই শিল্পী হিসেবে এনেছে, নাকি এ-ও স্পাই? গানের শিল্পী, না নাচের? নাকি চেহারা ভাল বলে ধরে এনেছে-কোরাস গাইবে? অথবা অ্যানাউন্সারও হতে পারে। পুরো নামটা কী মেয়েটার? মিত্রা চৌধুরী? মিত্রা ব্যানার্জী? মিত্রা সেন গুপ্তা বা ঠাকুরতা? কিংবা নাগ, ভৌমিক, রায়, চক্রবর্তী, মুখোপাধ্যায়…